শ্রীলঙ্কার পর এবার ডুবতে বসেছে নেপাল। ধসতে চলেছে দেশটির অর্থনীতি। পরিস্থিতি যাতে হাতের বাইরে বেরিয়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে আগেভাগেই সতর্ক হয়ে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিল সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত নেপালের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৭% শতাংশ কমেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, নেপালের ২০২১ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি ১১.৭৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল, যা ফেব্রুয়ারিতে ৯.৭৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ব্যাঙ্কের কাছে যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশিষ্ট রয়েছে যা দিয়ে শুধুমাত্র ৬.৭ মাসের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি আমদানি করা সম্ভব, যেখানে ব্যাঙ্কের লক্ষ্য সাত মাস।
ফলে এক্ষুনি পদক্ষেপ না নিলে বড়সড় সমস্যায় পড়তে চলেছে নেপাল, তা বলাই বাহুল্য।
দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ধসে পড়া থেকে আটকাতে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ চেয়ে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠিও দিয়েছে নেপাল রাষ্ট্র ব্যাঙ্ক।
একই সঙ্গে ব্যাঙ্কগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যানবাহন সহ অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ক্ষেত্রে ঋণ না দিতে। ২৭ টি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক করে এই ঋণ না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নেপাল রাষ্ট্র ব্যাঙ্ক।
আমদানিকৃত পেট্রোলিয়াম পণ্যের জন্য প্রতি মাসে ভারতকে ২৪ থেকে ২৯ বিলিয়ন টাকা দেয়। ব্যাঙ্ক কর্তাদের দাবি, সেদেশের ডুবন্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এহেন সিদ্ধান্ত।
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই পেট্রোলিয়াম আমদানির খরচ কমিয়ে ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন টাকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এই নির্দেশের সাপেক্ষে নেপাল অয়েল কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নগেন্দ্র শাহের অবশ্য দাবি, ব্যাঙ্কের এই প্রস্তাব মানা হলে ভয়াবহ পেট্রোল এবং ডিজেল সংকট দেখা দেবে দেশ জুড়ে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের জুলাই মাস অবধি তেল আমদানি বাবদ মাসে ১৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করত নেপাল। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির কারণে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই খরচ।
এমন অবস্থাতেই এই খরচ আবার অর্ধেক করার কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। কিন্তু একই কারণে অর্ধেক খরচে যে আগের পরিমাণের সমান জ্বালানি তেল আর পাওয়া যাবে না তা বলাই বাহুল্য। সেই কারণেই এই সঙ্কটের আশঙ্কা শাহের৷
হিমালয় ব্যাঙ্কের সিইও অশোক রানা জানিয়েছেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে যানবাহন সহ অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ব্যাঙ্ক লোন দেওয়া যাবে না। ব্যাঙ্কগুলো সেই নির্দেশ মেনেই চলছে।’ গাড়ির সংখ্যা কম হলে জ্বালানি খরচাও কম হবে বলেই দাবি তার।
তথ্য উপাত্ত যাই বলুক করোনা মহামারি নেপালের অর্থনীতিতে বড় ক্ষত রেখে গেছে। নেপালের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য নেপালের প্রস্তুতি ছিল না।
করোনায় নেপালের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেমন ভেঙে পড়েছে, তেমনি ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক অবস্থাও। কারণ, দেশটির অন্যতম আয়ের উৎস পর্যটন খাত একেবারে ভেঙে পড়েছে। নেপালের সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
হিমালয়ান টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ফ্লাইট বন্ধ থাকায় পর্যটকেরা নেপালে যেতে পারছেন না। উল্টো যেসব পর্বতারোহীরা দেশটিতে গিয়েছেন, সেখান থেকে ফিরতে গিয়ে তাঁরা বিপাকে পড়ছেন।
নেপালের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে, দেশটির আরেকটি আয়ের উৎস রেমিট্যান্স। কিন্তু কোভিডের কারণে লাখো প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। ফলে রেমিট্যান্স কমে গেছে।
অর্থাৎ করোনা মহামারিতে নেপালের নাজেহাল অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন অসম্ভব। বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনার দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে চাইলে নেপালের রাজনৈতিক অচলাবস্থারও পরিবর্তন জরুরি। তখনই হয়তো মহামারির মোকাবিলায় শক্তিশালী অবস্থানে যেতে পারবে দেশটি।
অর্থনৈতিক এই বিপর্যয়ের আরেকটি কারণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। আপাতদৃষ্টিতে এর পেছনে চীন ও ভারতের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বও বহুলাংশে দায়ী।
রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে নেপালে গণতন্ত্র বির্পযস্ত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বেইজিংয়ের প্রভাব বাড়া ছাড়া কমবে না। সীমান্ত রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যা উদ্বেগজনক। নয়াদিল্লির মতে, নেপাল বেশ কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
এক সময় নেপাল ছিল ভারত প্রভাবিত দেশ। দুটি হিন্দুপ্রধান দেশ হলেও ভারতের দাদাগিরিতে অসন্তুষ্ট ছিল নেপালিরা। কিন্তু সেটা চেপে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
কিন্তু গত কয়েক বছরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন নেপালে ভারতবিরোধী জনমত প্রবলভাবে দৃশ্যমান।
ভারতের একতরফা প্রভাববলয়ের দেশটিতে সম্প্রতিক সময়ে চীন শক্তপোক্ত জায়গাদখল করেছে। এটাকে ভারতীয় নীতির ব্যর্থতা হিসাবে দেখা হয়। বর্তমান রাজনৈতিক অস্থতিশীলতার ফলে শেষ পর্যন্ত ভারত নাকি চীনের লাভ হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে চীন দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেভাবে শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে তাকে দেশটির কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ভারতও অস্বীকার করতে পারবে না।
এর মানে হচ্ছে নেপালে চীনের দৃঢ় অবস্থান এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। এটাই হয়তো দিল্লির বড় মাথা ব্যথার কারণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার বলি হচ্ছে নেপাল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ