সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। তবে ভারতের সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা ও মামলার ঘটনা অনেকটা নিয়মিত হয়ে উঠেছে।
এদিকে বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করার অপরাধে থানায় অর্ধনগ্ন করে রাখা হলো সাংবাদিক এবং ইউটিউবারদের। মধ্যপ্রদেশের এ ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা ভারতে। সূত্র এনডিটিভি।
একজন সাংবাদিক এবং থিয়েটার শিল্পীসহ একদল পুরুষকে মধ্যপ্রদেশের একটি থানায় অন্তর্বাস পরা অবস্থায় একটি পোস্টে দেখা গেছে, যা এখন ভাইরাল। আটজনকে সামনে হাত দিয়ে দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
এই ছবিতে যেই সাংবাদিক ও ইউটিউবার রয়েছেন তার অভিযোগ, স্থানীয় এক বিজেপি এমএলএ’র বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভের খবর সংগ্রহে গেলে পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে আসে, মারধর করে ও জামাকাপড় খুলে কেবল অন্তর্বাস পরিয়ে রাখে।
ঘটনার সূত্রপাত (২ এপ্রিল) শনিবার। অভিযোগ, এক স্থানীয় সাংবাদিক এবং তার চিত্রগ্রাহক স্থানীয় বিধায়কের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ছবি তুলতে যান। সেখান থেকে পুলিশ তাদের আটক করে থানায় নিয়ে আসে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে এক নাট্যকর্মীও ছিলেন।
ঘটনাটি শনিবার মধ্যপ্রদেশের সিধি জেলায় ঘটেছিল যখন সাংবাদিক একটি নকল ফেসবুক প্রোফাইল ব্যবহার করে বিজেপি বিধায়ক কেদারনাথ শুক্লা এবং তার ছেলে গুরু দত্ত শুক্লার বিরুদ্ধে কথিত অশালীন মন্তব্য করার জন্য থিয়েটারশিল্পী নীরজ কুন্দের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদের সংবাদ কভার করতে গিয়েছিলেন।
অভিযোগ, থানায় এনে পুলিশ তাদের অন্তর্বাস পরা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখে। প্রায় ১৮ ঘণ্টা তাদের আটক করে রাখা হয়। সেই ছবি সামাজিক মাধ্যমে আসতেই তা ভাইরাল হয়ে যায়।
ওই সাংবাদিকের অভিযোগ, পুলিশ তাদের মেরেছে, খারাপ ব্যবহার করেছে। কেন তারা বিধায়কের বিরুদ্ধে খবর করতে গিয়েছিল, সে প্রশ্ন করা হয়েছে। সাংবাদিকের দাবি, তার চিত্রগ্রাহককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুয়া মামলাও করা হয়েছে।
কনিষ্ক তিওয়ারি নামে এই সাংবাদিক বলেন, তিনি ও তার ক্যামেরা পারসনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে জনগণের শান্তি বিনষ্টসহ কয়েকটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এমএলএ’র বিরুদ্ধে কেন সংবাদ করা হচ্ছে- পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসা করে।
স্থানীয় এক বিজেপি এমএলএ’র বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভের খবর সংগ্রহে গেলে পুলিশ তাকে থানায় ধরে নিয়ে আসে, মারধর করে ও জামাকাপড় খুলে কেবল অন্তর্বাস পরিয়ে রাখে।
কনিষ্ক তিওয়ারি বলেন, আমি সিধি জেলার বাসিন্দা এবং সাংবাদিক। শনিবার জোর করে থানায় নিয়ে আমাকে মারধর করা হয়। ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে, ২ তারিখ রাত ৮টায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৩ তারিখ সন্ধ্যা ৬টায় মুক্তি দেওয়া হয়।
তিওয়ারির অভিযোগ ওই থানার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাই ছবিটি তোলেন। তিনি বলেন, আমাদের হুমকি দেওয়া হয়, আমরা যদি ওই খবর প্রচার করি তবে নগ্ন করে আমাদের শহরের রাস্তায় ঘোরানো হবে। এই ছবিটি পুলিশই ভাইরাল করেছে। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
পুলিশ বলছে, তিওয়ারির বিরুদ্ধে আগের মামলা রয়েছে। ছবি ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় পুলিশ শুধু জানিয়েছে, তদন্ত করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভারতে কয়েক বছর ধরেই সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা–মামলার ঘটনা বাড়ছে, এমন অভিযোগ করে আসছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, ভারতে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। বিশেষত কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরোধিতা করায় ভারতে বিভিন্ন সময় সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত এসেছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র’ বলে যে গর্ব ভারত করতো, তা আজ মোদির ঝড়ে ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি বেশ কিছু সূচকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গিয়েছে আশঙ্কাজনকভাবেই। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভারতে বিপন্ন হয়েছে গণতন্ত্র। প্রতিবাদ করলেই সরকারের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে। বিনা কারণে ইউএপিএ’র ধারা দিয়ে মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এমনটিই দাবি করেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্থা ‘সিভিকাস’।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিক থেকে ভারতকে ‘নিপীড়িত’ দেশগুলোর তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।
সাংবাদিকদের উপর পুলিশের অত্যাচার, রাজনৈতিক নেতাদের চাপ সৃষ্টি, দুর্নীতিবাজ অফিসার ও অপরাধমূলক গোষ্ঠীর প্রতিশোধের হুমকি; সব মিলিয়ে ভারতের খর্ব হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা৷
দ্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, হিন্দুবাদী সরকারের লাইনে থাকতে সংবাদমাধ্যমগুলির উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে৷ যে সব সাংবাদিকরা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী বা কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে লিখছেন বা মুখ খুলছেন, তাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে চরম হেনস্থা, হুমকি দেওয়া হচ্ছে৷ বিশেষ করে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারী সাংবাদিকরা৷
এদিকে, ফ্রিডম হাউস বলছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নাগরিক স্বাধীনতার অবনতি হচ্ছে। তারা আরো বলেছে যে ‘মুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ কাতার থেকে ভারতের এই পতন’ বিশ্বের গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে।
মোদির শাসনকালে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে ভারত এখন পাকিস্তানের মতই স্বৈরাচারী, এবং বাংলাদেশ ও নেপালের চাইতেও সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ। কর্তৃপক্ষ গণতন্ত্রকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়ায় এবং নাগরিক অধিকারের ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ হওয়ায় ভারতের এই অবনতি হয়েছে। মোদির বিভিন্ন নীতিসমূহ ভারতে মুসলিম-বিরোধী অনুভূতি এবং ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দিয়েছে, এবং তা ভারতের গণতন্ত্রের কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ভারতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দ্রুত কমছে। সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখার সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাকে সরকার ও কর্তৃপক্ষ ক্রমশ অগ্রাহ্য করছে। কেউ তাদের সমালোচনা করলেই হেনস্তা করা হচ্ছে। দেশদ্রোহের নামে সাংবাদিকদের জেলে পোরা হচ্ছে, অসংখ্য মামলার জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য এটা বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ