জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা নেই দেশের শিশুদের। তবে দেশের শিশুরাই সর্বোচ্চ মূল্য দিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন বা প্রায় দুই কোটি শিশু বিরূপ আবহাওয়া, বন্যা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশগত অভিঘাতের শিকার। এদের মধ্যে অনেক শিশুরই ঠাঁই হয় শহরের বস্তিতে। তাদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। শোষণমূলক শিশুশ্রম, শিশু বিয়ে এবং পাচারের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় লাখ লাখ শিশু।
জাতিসংঘের জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ বাংলাদেশ), ওয়ার্ল্ড ভিশন ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) আয়োজনে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ, চিলড্রেন অ্যান্ড ভায়োলেন্স টপ দ্যা এজেন্ডা অ্যাট ইনোভেটিভ ভিশনারি স্পিকারস ইভেন্ট’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন।
গতকাল বুধবার(০৬ এপ্রিল) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এ পরামর্শক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাল্য বিবাহ, শিশুশ্রম ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার চালিকা শক্তি হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন সভার মূল বিষয় ছিল।
বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। ইউনিসেফের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। শিশুরা জলবায়ু ও পরিবেশগত অভিঘাতের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকিতে তা তুলে ধরে এই সূচক। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের শিশুরা দায়ী নয়, অথচ তাদেরকেই এর জন্য সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ুজনিত সংকটের সম্মুখভাগে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুরা। তাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, বাল্যবিবাহের শিকার, এমনকি যৌনকর্মীতেও পরিণত হচ্ছে।
শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দূত বলে মন্তব্য করেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের জাতীয় পরিচালক সুরেশ বার্টলেট। তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে শিশুদের সম্পৃক্ত করা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে—এমন জলবায়ুবিষয়ক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা প্রয়োজন।
জলবায়ু সংকট নারী ও শিশুদের মতো অরক্ষিত গোষ্ঠীগুলোকে আরও নাজুক করে তোলে বলে জানান বাংলাদেশে আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমিন। তিনি বলেন, পরিবেশগত অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্পদের ঘাটতি, সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতি কষ্টার্জিত উন্নয়ন অর্জনগুলোকে প্রভাবিত করে।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার অবসান এবং পরিবেশগত টেকসই অবস্থা নিশ্চিত করা গেলে তা আন্তসংযুক্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ুজনিত সংকটের সম্মুখভাগে। এদের মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে শহরের বস্তিতে বাস করা শিশুরা। তাদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে, বাল্যবিবাহের শিকার, এমনকি যৌনকর্মীতেও পরিণত হচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের চাইল্ড অ্যান্ড ইয়ুথ ফোরামের যুবকর্মী মো. আলমগীর কবির বলেন, পর্যাপ্ত তহবিল, সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ তরুণ জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও এর প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সঠিক পথ বেছে নিতে সাহায্য করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিপাকে বিশ্বের শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বয়স্ক ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশুরা। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বর্তমান সময়ে যেসব শিশুরা জন্মগ্রহণ করছে, তারা তাদের পূর্ববতী প্রজন্মের তুলনায় সাত গুণ বেশি বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদি এ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া সম্ভব হয়, তবে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
শিল্প ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি তৈরির সময় বাতাসে মেশে বিভিন্ন কার্বন গ্যাস, এর বেশিরভাই কার্বন ডাইঅক্সাইড। এসব গ্যাস সূর্যের আলো থেকে তাপ ধরে রাখে। ফলে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপমাত্রা।
এই বাড়তি তাপমাত্রাই বদলে দিচ্ছে জলবায়ু, এক দিনে বরফ গলে যাচ্ছে, আরেক দিকে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। চরম আবহাওয়া ডেকে আনছে মৃত্যু আর ধ্বংস।
একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত নিউ সায়েন্সে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, তরুণরা ঠিক কতবার তাদের জীবদ্দশায় এরকম ঘটনাগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকে। বিবিধ জলবায়ু পরিস্থিতি ও জনসংখ্যাভিত্তিক মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা ছয়টি চরম আবহাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- দাবানল, অনাবাদ, খরা, নদীর পানি বেড়ে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়।
দেখা গেছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জন্ম নেওয়া প্রায় প্রতিটি প্রজন্মই বিভিন্ন শিল্প গড়ে ওঠার সময়ে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত চরম উষ্ণতার সম্মুখীন হয়েছে। এর পরিণাম খুবই ভয়াবহ।
বর্তমান জলবায়ু আইন অনুযায়ী, ২০২০ সালে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা ১৯৬০ সালের শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ থেকে সাত গুণ বেশি চরম মাত্রায় জলবায়ুজনিত ঘটনাগুলোর শিকার হবে। যেমন— ১৯৬০ সালে যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা জীবনে চারবার তাপমাত্রার বৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, ২০২০ সালে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবেন ৩০ বার।
তবে যদি তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয় তবে ২২ বারের মতো এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে এবং উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সীমিত হলে এই অভিজ্ঞতা হবে ১৮ বার। এদিক থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পৃথিবীতে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করা কারো চেয়ে ২০২০ সালে জন্মগ্রহণ করা একটি ছয় বছর বয়সী শিশু অনেকবার দাবানলের ঘটনার সম্মখীন হবে। এছাড়া অন্তত দুবার দাবানল ও ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, তিনবারের বেশি নদীর পানি বেড়ে যাওয়া, চার বারের বেশি অনাবাদ, পাঁচ বারের বেশি খরা ও ৩৬ বারের মতো তাপমাত্রার বৃদ্ধির অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে সে।
এখানে ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিষয়টিও লক্ষ্যনীয়। ধনী দেশগুলোর চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মতো দরিদ্র দেশগুলো অধিক হারে চরম আবহাওয়ার সম্মুখীন হবে। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উষ্ণতা কমিয়ে আনলে এই ঝুঁকিকে ‘কিছুটা সীমিত’ করা যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন—এক্ষেত্রে তাপমাত্রার উষ্ণতা বৃদ্ধি শতকরা ৪০ ভাগে কমে আসবে। তবে আরো দ্রুত ও বাছবিচারহীনভাবে এর বৃদ্ধি ঘটলে তখন এই ক্ষতির ভয়াবহতা রোধ করা সম্ভব হবে না।
এদিকে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের শিশুরা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ইউনিসেফ। এতে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের শিশুরা তাপপ্রবাহ ও বন্যার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির ক্ষেত্রে অত্যন্ত অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
এই অঞ্চলে খরা, বন্যা, বায়ু দূষণ ও নদী ভাঙনের কারণে লাখ লাখ শিশু গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবা ও পানিবিহীন অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও কোভিড-১৯ মহামারি একসঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সঙ্কট তৈরি করেছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইদানীংকালে খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা নয় তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর এই আমূল পরিবর্তনে অভিযোজন করতে গিয়ে বেশি দুর্যোগের কবলে পড়ছে শিশুরা। জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার দৈনন্দিন অনুষঙ্গগুলোর গুণগত মান খারাপ করে দেয়। ফলে শিশুরা নানারকম স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মুখে পড়ে।
তারা বলেন, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের তালিকায় থাকা ওপরের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর জলবায়ু পরিবর্তনের এ ক্ষতিকর প্রভাবের অসহায় শিকারে পরিণত এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রান্তিক শিশুরা। সম্প্রতি বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে ধারণার চেয়েও বেশি ঝুঁকিতে পড়বে উপকূলীয় শিশুরা।
আরও বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাণে বাঁচার জন্য যেসব পন্থা অবলম্বন করতে হয় তার বেশিরভাগই শিশুদের অজানা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে চাই সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এখনই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, যেখানে শিশুদের ওপর এর প্রভাব বেশি মারাত্মক। বৈশ্বিক এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একযোগে কাজের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি আমরা যদি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করি, তবেই সম্ভব সব দুর্যোগ মোকাবিলা করে শিশুসহ সবার নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ