বর্তমান সময়ের আলোচিত ও মর্মস্পর্শী ঘটনা সড়ক দুর্ঘটনা। বাংলাদেশে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব দুর্ঘটনায় জীবন খাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। মূল্যবান জীবনের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে সম্পদ, ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। সড়ক দুর্ঘটনায় হাজারো পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গতকাল সোমবার মার্চ মাসের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য জানিয়েছে। সংগঠনটির হিসাবে জানুয়ারি মাসে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৬৩, ফেব্রুয়ারিতে ৬৭ এবং মার্চ মাসে ৯৬। প্রতি মাসেই সংখ্যাটি বাড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের পরিচয়ের হিসাবে সবচেয়ে বেশি ৭৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নিহত হয়েছেন; যা ফেব্রুয়ারির তুলনায় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৭৮ দশমিক ৬০ শতাংশ।
সোমবার (৪ এপ্রিল) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। দেশের ৭টি জাতীয় দৈনিক, ৫টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নিহতের মধ্যে ৬১ জন নারী ও ৯৬ জন শিশু রয়েছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৫৮টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮৯ জন। আহত হয়েছেন আরও ৬৪৭ জন। আর নিহতের মধ্যে ৬১ জন নারী ও ৯৬ জন শিশু রয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, সারা দেশে গত মার্চে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৫৮টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে ১৭৬টি। তাতে নিহত হয়েছে ২২১ জন, যা মোট নিহতের ৩৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৬২ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছে ৭৩ জন, যা মোট মৃত্যুর ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ সময়ে পাঁচটি নৌ-দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছে। ১১টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ১৭ নিহত এবং ৮ জন আহত হয়েছে।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী নিহত হয়েছে ২২১ জন, যা মোট মৃত্যুর ৩৭ দশমিক ৫২শতাংশ, বাসযাত্রী ৩৯ জন, যা মোট মৃত্যুর ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৩৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেট কার যাত্রী ১৭ জন, যা মোট মৃত্যুর ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ, থ্রি-হুইলার আরোহী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-টেম্পো-জিপ-পাওয়ার টিলার) ৮১ জন, যা মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-চান্দের গাড়ি-মাহিন্দ্র-টমটম) ২৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ১১ জন, যা মোট মৃত্যুর ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে জাতীয় মহাসড়কে ১৬৭টি যা মোট সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ; আঞ্চলিক সড়কে ১৭৯টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ; গ্রামীণ সড়কে ৬৮টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ; শহরের সড়কে ৩৯টি যা মোট সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং অন্যান্য স্থানে পাঁচটি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, গত মার্চে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৫৮টি। এর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ৭১টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ; নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ১৬৮টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ। পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া ১৫৯টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, যানবাহনের পেছনে আঘাত করেছে ৪৬টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ১০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ঘটেছে ১৪টি, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, সকালে ৩৪ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, দুপুরে ১৯ শতাংশ, বিকেলে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং রাতে ১৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে: দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, প্রাণহানি ২৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, প্রাণহানি ১১ দশমিক ২০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি ২১ দশমিক ৭৩ শতাংশ, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ, প্রাণহানি ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ঘটেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, ট্রাকসহ পণ্যবাহী দ্রুতগতির যানবাহন ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
জানুয়ারি মাসে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৬৩, ফেব্রুয়ারিতে ৬৭ এবং মার্চ মাসে ৯৬। প্রতি মাসেই সংখ্যাটি বাড়ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের কমকর্তারা বলেছেন, এ আতঙ্কজনক প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষার্থী এবং শিশু।
বিশ্বব্যাংকের মতে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তিনগুণ বেশি। এসব কারণে দেশে সেবছর ১১ হাজার ৬৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বলে জানায় তারা। সে বছর সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশের জিডিপির ৫.৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও উল্লেখ করে তারা।
ট্রাফিক সপ্তাহ, ট্র্যাফিক পক্ষ, র্যাব-পুলিশ তৎপরতা চলছে, চলছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চিহ্নিতকরণের কাজ। ওদিকে সতীর্থের অকাল মৃত্যুর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করছে। কিন্তু কিছুতেই সুফল মিলছে না। দুই বছর আগে ২০১৯ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের পরও সড়ক দুর্ঘটনা মোটেও কমেনি। বরং বেড়েছে আর বাড়ছেই। আশা করা গিয়েছিল, আন্দোলনের ফলে সড়কে ফিরবে শৃঙ্খলা, চালক এবং জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে। এর ফলে কমবে দুর্ঘটনার হার। অত্যন্ত নিরাশ হয়ে বলতে হয়, এর কোনোটাই হয়নি। বড় বড় আন্দোলনও এক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি। সবকিছু যেমন চলছিল তেমনই চলছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় কেবল শিক্ষার্থী মারা যাচ্ছে তা নয়, বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ, পাঠাও চালক, হালকা-ভারী যানবাহনের চালক-কর্মীও মারা যাচ্ছে। বুয়েটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মিনিবাসই বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো অনেকবার চিহ্নিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনকে সঠিকভাবে কার্যকরের বিকল্প কিছু নেই। আমাদের নিজেদের স্বার্থে সড়কে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যেন একটি মূল্যবান প্রাণও সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে না যায়। একজন মায়ের বুকও যেন খালি না হয়। একজন নারীও যেন বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন এতিম না হয়। আমাদের যেমন নিরাপদ সড়ক পাওয়ার অধিকার আছে, তেমন কিছু কর্তব্যও আছে। পথচারী, মালিক, চালক, হেলপার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎভাবে কর্তব্যগুলো পালন করে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াল অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারি। নিজ দায়িত্বে সচেতন হয়ে সুস্থ থাকি, অন্যকে এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতা হচ্ছে সড়কে প্রাণ যাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। সরকারের নানা বিভাগ, একেকজন একেক দিকে। কেউ সঠিক ভাবনা ভাবছে না। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুই যেন আমাদের নিয়তি হয়ে উঠছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া চালক ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
তারা বলেন, দিনের পর দিন এ অবস্থা তো চলতে পারে না। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সড়ক দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকেরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
তারা বলেন, আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রয়োগে ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে তাদের ঢেলে সাজাতে হবে, অন্যথায় নতুন করে দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৯
আপনার মতামত জানানঃ