চীনকে নিয়ে নতুন একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায় রাশিয়া। চীন সফররত রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ গতকাল বুধবার(৩১ মার্চ) এক ভিডিও বার্তায় এই আকাঙ্ক্ষার কথা জানান ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এটিই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম চীন সফর। এ সময় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ চীনের তুনসি শহরে মিলিত হন। ইউক্রেন সংকটের মাঝে এই বৈঠককে ঘিরে উত্তেজনার আশঙ্কা আরও বেড়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক নিয়ে একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভিডিওতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেন, ‘চীন এবং রাশিয়া একটি নতুন ন্যায়সঙ্গত, গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে’।
ভিডিওতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বিশ্ব একটি গুরুতর পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনারাসহ (চীন) আমরা মিলে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো নিয়ে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক, ন্যায়পরায়ণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পাঁচ সপ্তাহ গড়ালেও এখনো এর নিন্দা জানায়নি বেইজিং। পাশাপাশি রাশিয়াকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে চীন সহযোগিতা করতে চাচ্ছে, এমন অভিযোগ তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। এমন পথে না হাঁটতে সম্প্রতি এক ভিডিও কনফারেন্সে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে সতর্ক করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
গতকাল রাশিয়া ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দুই দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধাবনত অবস্থার চিত্র চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
তবে পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সাংবাদিকদের বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং বহুমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে মস্কো ও বেইজিং কাজ করে যাবে।
রাশিয়া ও চীনের সহযোগিতার কোনো সীমারেখা নেই বলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের প্রচেষ্টারও কোনো সীমা নেই, নিরাপত্তা বজায় রাখতে আমাদের প্রচেষ্টার কোনো সীমা নেই, আধিপত্যের বিরোধিতার ক্ষেত্রেও কোনো সীমা নেই।’
এদিকে, ইউক্রেনে রুশ সামরিক আগ্রাসনের জের ধরে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর একের পর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেলেও বেইজিং এখনও এই আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি। বরং দুই দেশের কূটনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরালো হচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মার্কিন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারেও ‘ইতিবাচক ইঙ্গিত’ দিয়েছে চীন। সেই সঙ্গে, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনকে ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কয়ারে চীনের বিক্ষোভ দমনের সঙ্গে তুলনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে চীন সরকার।
এর আগে, গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক যৌথ বিবৃতিতে চীন এবং রাশিয়া বলেছিল, ‘দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে কোনো সীমারেখা নেই’। আর গত সোমবার (২৮ মার্চ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেছেন, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক এখন সর্বকালের সর্বোত্তম পর্যায়ে রয়েছে।
‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে বিশ্ব একটি গুরুতর পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনারাসহ (চীন) আমরা মিলে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলো নিয়ে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক, ন্যায়পরায়ণ ও গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাব।’
ইউক্রেন আগ্রাসনে সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা করেনি এমন আরেকটি দেশ হচ্ছে ভারত। চীন সফর শেষে লাভরভ ভারতে যাবেন বলেও আশা করা হচ্ছে। বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে নয়াদিল্লিতে দুই দিনের সফরে আসবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে এমটিই জানানো হয়েছে।
চীনের মতো ভারতও ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কও স্বাভাবিক রাখতে উদ্যোগী হয়েছে ভারত সরকার। একাধিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রাশিয়াকে সুইফট থেকে বাদ দেওয়ার পর দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন স্বাভাবিক রাখতে বিকল্প উপায় সন্ধান করতেও শুরু করেছে ভারত।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহের বৈঠকে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের অন্যান্য দিক নিয়েও আলোচনা হতে পারে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া নিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখনো প্রেসিডেন্ট পুতিন চীনের দিকে তাকিয়েছিলেন এবং সাড়া পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বেইজিং শুধু তেল এবং গ্যাস কেনা নিয়েই মস্কোর সঙ্গে ৪০ হাজার কোটি ডলারের চুক্তি সই করে, যা সেই সময়ে রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভরাডুবি থেকে থেকে বাঁচিয়েছিল। অবশ্য অনেক পর্যবেক্ষক বলেন, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল নিয়ে চীন অস্বস্তিতে পড়লেও সস্তায় এবং সহজ শর্তে রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ কেনার সুযোগ তারা তখন হাতছাড়া করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্হা ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইপিআরআই) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ক্রিস মিলার লিখেছেন, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের ইস্যুতে ২০১৪ সালের পর গত ৮ বছরে চীন ও রাশিয়া দিন দিন আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার কৌশল হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকেই চীন ও রাশিয়া একটি অভিন্ন প্ল্যাটফরম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে। এর পেছনে দুই দেশের সমান স্বার্থ রয়েছে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়ার পক্ষ থেকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছাকাছি আসার চেষ্টা সত্ত্বেও যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ করে গেছে, সেই ভীতি থেকে মস্কো চীনের দিকে ঝুঁকেছে। ১৯৯৬ থেকে পরের কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়া তাদের সীমান্ত সমস্যাগুলো সমাধান করে। ২০০১ সালে তারা একটি মৈত্রী চুক্তি করে। নিজেদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইসু্যতে, যেমন—ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া—দুই দেশ অভিন্ন সুরে কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্রের তোয়াক্কা না করে ইরানকে গত বছর এসসিওর পূর্ণ সদস্য করা হয়েছে। এমনকি সম্প্রতি কাজাখস্তানে রুশ সৈন্য মোতায়েনকে সমর্থন করেছে চীন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এশিয়া ও ইউরোপে জোট তৈরির এবং তত্পরতা বাড়ানোর যত চেষ্টা আমেরিকা করবে চীন ও রাশিয়া ততই ঘনিষ্ঠ হবে। কারণ, বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নিজেদের ঐক্যকে একটি অস্ত্র হিসাবে বিবেচনা করছে এই দুই দেশ।
চীন এখন রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আধুনিক অস্ত্রের বড় ক্রেতা। রাশিয়ার রফতানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। গত বছর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৫ সালে ছিল ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল থেকে পাইপলাইন দিয়ে চীনে রাশিয়ার গ্যাস যাচ্ছে। দ্বিতীয় আরেকটি পাইপলাইন বসানোর চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, শুধু সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বা রাশিয়ার চাওয়া নয় ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের পক্ষ নিয়ে আমেরিকাকে কোণঠাসা করার পেছনে চীনের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে।
ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ক্রিস মিলার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপসহীন অবস্থান দেখে চীন তাইওয়ান নিয়ে চিন্তিত। চীন মনে করছে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যুতেও যে তারা এমন কঠোর অবস্থান নেবে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন নিয়ে রেষারেষিতে সফল হোক, চীন তা চায় না। ইউক্রেনের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও বা সে দেশে রুশ সামরিক অভিযানে অস্বস্তি বোধ করলেও কোনো যুদ্ধ বাধলে চুপ করে থাকা চীনের জন্য এ দফায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৪
আপনার মতামত জানানঃ