করোনাকালে বেড়েছে নারী উন্নয়নে বড় বাধা বাল্যবিবাহ, যা নারী নেতৃত্বের পথেও অন্তরায়। করোনাকালে স্কুলগুলো বন্ধ, কাজ না থাকা, যৌন সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা। শুধু তাই নয়, লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়া ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাও বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির বড় কারণ। ‘বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বৃদ্ধিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
সমীক্ষায় ৪১.৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অন্যদিকে ৩১.২ শতাংশ লকডাউন দীর্ঘায়িত হওয়া এবং ৩৩.৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের ইউএসএআইডি অর্থায়নে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়। জরিপে ৮৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, বাল্যবিবাহের কারণে শিশু চরম মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর। এমন কথা বলেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২.৮ শতাংশ। এছাড়াও শিশুর অপুষ্টি (৮২.১ শতাংশ), বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি (৪০.৩ শতাংশ), প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মদান (৪১.৪ শতাংশ) এর মতো তথ্য-উপাত্ত সমীক্ষায় উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে ‘দ্যা জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুশন (জেসি) প্রমিসিং প্রাকটিস ইন বাংলাদেশ’ নামক নতুন প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বাল্যবিবাহ ও জেন্ডার সহিংসতা রোধে সরকার আরো জোরালোভাবে কাজ করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন, ইউএসএআইডির কর্মকর্তা কেইন ডব্লিউ হ্যাসন প্রমুখ।
বাল্যবিবাহের কারণে শিশু চরম মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মা ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর। এমন কথা বলেছেন জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২.৮ শতাংশ।
আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে ২০২০ সালে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অপরিণত বয়সের মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে আরো অতিরিক্ত ২৫ লাখ মেয়ে। গত ২৫ বছরের মধ্যে এবারই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি।
২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় দুই দফায়। প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের দুয়ার।
সশরীরে ক্লাস শুরু হয় মাধ্যমিক স্কুলে। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবার পর সশরীরে ক্লাস শুরু হয় প্রাথমিকে। করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দ্বিতীয় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয় গত ২১ জানুয়ারি। এ দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস।
২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। আর ২ মার্চ থেকে আবারও শুরু হয় প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস। সার্বিক পরিস্থিতিতে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীর ক্লাসে ফেরা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগে প্রায় ১৭ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষের আগে প্রায় ৩৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর পেছনে অন্যতম কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তি এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি স্কুলের পথ ভুলতে থাকে। করোনার কারণে এসব পরিবারে দারিদ্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এ ছাড়া নতুন নতুন পরিবারও দরিদ্র হয়েছে। ফলে ঝরে পড়ার হার আরো বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেখানে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারটি মাথায়ই রাখেনি। এসব দরিদ্র পরিবারের অনেক সন্তান শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে, যারা আর স্কুলে না-ও ফিরতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থতম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে মেয়েদের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বিয়ে হচ্ছে ১৫ বছরের আগেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছেলেদের সমান বা কিছু বেশি হলেও উচ্চশিক্ষা এবং চাকরিতে অনেক পিছিয়ে মেয়েরা। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে নারী মাত্র ২৭ শতাংশ।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নারী ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের এই পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিয়ে। শিশু মেয়ে হয় শিশু মা। ফলে বাড়ে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাল্যবিয়ে বন্ধে এখনই উদ্যোগ না নিলে চ্যালেঞ্জ হবে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বজুড়ে ১৮ বছরের বেশি বয়সে বিবাহিত মেয়েদের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিতা মেয়েরা।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনা মহামারি দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়িয়েছে। অভাবের কারণে দরিদ্র পরিবারের অভিভাবক অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারের খরচ কমাতে চান। বিয়ের পর মেয়েটির স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
তারা বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রতি মাসে উপবৃত্তি প্রদান নিশ্চিত করা এবং দুপুরের খাবার নিয়মিত দেওয়া হলে দরিদ্র অভিভাবকরা মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হবেন। তারা তখন আর মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন না। এতে বাল্যবিয়ে কমবে, নারী শিক্ষার হারও বাড়বে।
আরও বলেন, বাল্যবিয়ে স্থায়ীভাবে প্রতিরোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। বাল্যবিয়ের কুফল সব অভিভাবককে বুঝতে হবে, অথবা তাদের বোঝাতে হবে। ছেলেমেয়েদেরও বোঝাতে হবে যে, অল্প বয়সে বিয়ে করা ভালো নয়। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সর্বত্র প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়ে যেতে হবে। যেসব কারণে বাল্যবিয়ে হয়, তা দূর করার জন্য অভিভাবক, সমাজ ও সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। একইসঙ্গে জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটিগুলোকে কার্যকরভাবে সক্রিয় রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৩
আপনার মতামত জানানঃ