কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন ব্লকে গত এক বছরে এক ডজনের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের রহস্যের কোনো কূলকিনারা এখনো হয়নি। এরই মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে ঘনবসতি ও অসতর্কতার কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বারবার।
কিন্তু স্থানীয়দের দাবি, এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে ক্যাম্পগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তার খেসারত দিচ্ছেন তারাও। অগ্নিকাণ্ডে তাদের শতশত বসতবাড়ি পুড়ে যাচ্ছে।
ঘুরে ফিরে কেনই বা রোহিঙ্গা কাম্পে আগুন লাগছে, এর নেপথ্যের কারণ কী এমন নানা প্রশ্নও জেগেছে। আর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগার নেপথ্যের কারণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলতে না পারলেও উখিয়ার সচেতন মহল বলছে, পরিকল্পিতভাবে গ্যাসের ব্যবহার না জানা, অসতর্কতা, ঘিঞ্জি পরিবেশে রোহিঙ্গাদের ঘর তোলা ও বসবাসের জন্য নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
অপর দিকে রোহিঙ্গারাই বলছে, তাদের রেজিস্টার্ড ও আন-রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। তাছাড়া ক্যাম্পে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ফলে বারবার ক্যাম্পগুলোয় আগুনের ঘটনা ঘটছে।
স্থানীয়রা জানান, ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ১০টি নির্দেশনা মেনে চলতে সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির দায়সারা রিপোর্টে সন্তুষ্ট নন তারা। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বেপরোয়া আচরণ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছেন তারা।
একাধিক জনপ্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী, সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন অগ্নিকাণ্ডের বেশিরভাগ ঘটনা পরিকল্পিত নাশকতা বলে উল্লেখ করেন। প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসা বা আল ইয়াকিন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাদের মদদেই ক্যাম্পগুলোতে সিরিজ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা নামে একটি শরণার্থী শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যাওয়ায় তিন হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় হারিয়েছেন। এর আগে ২ জানুয়ারি উখিয়া বালুখালী ২০ নম্বর ক্যাম্পের জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত করোনা হাসপাতালের জেনারেটর থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৫ জন রোহিঙ্গা। তখন ১০ হাজারের মতো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গত ৮ মার্চ ৫ নম্বর ক্যম্পে।
এদিকে বারবার এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল। গত এক বছরে এভাবে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তাদের মতে এটি রহস্যজনক। সচেতন মহলের মত এর পেছনে কোন মহলের ষড়যন্ত্র বা নাশকতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
স্থানীয়দের দাবি, এসব অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা অত্যন্ত সুকৌশলে ক্যাম্পগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তার খেসারত দিচ্ছেন তারাও। অগ্নিকাণ্ডে তাদের শতশত বসতবাড়ি পুড়ে যাচ্ছে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসুদ্দৌজা নয়ন বলেন, সবগুলো অগ্নিকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আশা করা হচ্ছে খুব শিগগিরই রহস্য উদঘাটন হবে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি।
রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, শরণার্থী শিবিরগুলোতে বারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও তা প্রতিরোধে শক্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শিবিরে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর শিবিরে ৫০-৬০টি মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করার মতো ‘প্রযুক্তি’ তাদের হাতে নেই। তবে আগের চেয়ে অগ্নিকাণ্ড কমেছে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় চারটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে সোমবার (১৭ জানুয়ারি) উখিয়ার ইরানি পাহাড়ের ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ২৯টি ঘর পুড়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। দেশে সেই প্রযুক্তিও নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষয়ক্ষতি ও ঘটনাস্থল বিশ্লেষণ করে ঘটনার কারণ অনুমান করা হয়ে থাকে।
তিনি আরও জানান, মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ক্যাম্পে শীত মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সবাইকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে আগের তুলনায় শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা কমেছে।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে, শিবিরে বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে। তবে এটা সত্য, কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ঘটছে। কর্তৃপক্ষের উচিত ক্যাম্পে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক নেভানোর ব্যবস্থা রাখা। এ ছাড়া আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দরকার। তাছাড়া আগুনের ঘটনা থামবে না।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের কর্মী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু খারাপ লোক রয়েছে, যারা আগুন লাগার ঘটনায় জড়িত। তারা চায় এখানে সবসময় অশান্তি থাকুক। তাছাড়া কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অবহেলার কারণেও ঘটে থাকে। ফলে শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানায়, শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা উদ্বেগনজনক হারে বাড়ছে। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ৮৪ বার আগুন লাগে, যা আগের বছরের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। এতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, গৃহহীন হয়েছেন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।
এইচআরডব্লিউ বলছে, এসব ঘটনায় রোহিঙ্গাদের অবহেলার কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ নাশকতার কথাও বলছেন। তবে, বাস্তবে কী ঘটছে সেটা জানা যাচ্ছে না। কারণ, আগুন লাগার ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, শিবিরে বারবার আগুন লাগার কারণে মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শিবিরে অগ্নিনির্বাপণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রসহ পানির ব্যবস্থা না থাকায় বারবার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে শত শত ঘর।
তারা বলেন, শিবিরে আগুন লাগার কারণ বের করা না গেলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা অসম্ভব। সবার সমন্বিত তদন্তে কোনটি অগ্নিকাণ্ড আর কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা, তা বের করা দরকার। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৩
আপনার মতামত জানানঃ