
নারী নির্যাতনে চতুর্থ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ নারী-শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
এদিকে শত শত লোকের সামনে রাস্তার মোড়ে প্রকাশ্যে তরুণীকে জুতাপেটা করার অভিযোগ উঠেছে যশোর সদর উপজেলার চূড়ামনকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে। ওই তরুণীকে জুতাপেটার পাশাপাশি পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে পেটানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সন্ধ্যা ৭টার দিকে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের আব্দুলপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শুক্রবার নির্যাতনের দুটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
প্রধান অভিযুক্ত আনিসুর রহমান যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য। নির্যাতনের শিকার ওই তরুণ-তরুণী যশোর সদর উপজেলার আব্দুলপুর গ্রামের বাসিন্দা। তারা একে অন্যের নিকট আত্মীয় বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন।
তরুণীকে নির্যাতনের অভিযোগে ইউপি সদস্যসহ ৪ জনের নামে শুক্রবার ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা বাদী হয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
তরুণীকে জুতাপেটার পাশাপাশি পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে পেটানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ওই তরুণী স্থানীয় এক লোকের বাইসাইকেলে চড়ে পাশের গ্রামের ওয়াজ মাহফিল থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। আবদুলপুর গ্রামের মোড়ে পৌঁছালে অনৈতিক কাজের অভিযোগ করে ইউপি সদস্য আনিসুর রহমানসহ কয়েকজন তাদের আটকে রেখে শত শত মানুষের সামনে জুতা ও লাঠি দিয়ে পেটান। খবর পেয়ে ওই তরুণীর মা–বাবা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, শতাধিক মানুষের সামনে তরুণীকে জুতা দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাচ্ছেন ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান। ওই তরুণী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ইউপি সদস্যর পাশে থাকা কয়েক যুবক লাথি মারেন। অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে তরুণীর সঙ্গে থাকা যুবককেও এলোপাতাড়ি মারধর করেন ইউপি সদস্য ও তার সঙ্গে থাকা কয়েক যুবক।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণীর হাত ও পা ধরে রেখেছেন কয়েক যুবক। ইউপি সদস্যের অনুসারী আইয়ুব, ভুট্ট, আবদুল আলীমসহ তিন–চারজন লাঠি দিয়ে তরুণীকে হাত-পায়ের গোড়ালিতে বেধড়ক মারধর করছেন। ওই তরুণীর সঙ্গে থাকা যুবককেও নির্যাতন করতে দেখা যায়।
নির্যাতনের শিকার তরুণীর বাবা বলেন, গত ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমার মেয়ে আত্মীয় এক যুবকের বাইসাইকেলে চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে ওয়াজ মাহফিল শুনতে যায়। ফেরার পথে তাদের বাইসাইকেল গতিরোধ করে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে এনে দুইজনকেই অশালীন কথাবার্তা বলতে থাকে ইউপি সদস্য আনিসুর রহমান, তার সহযোগী আইয়ুব আলী, ভুট্টো, আব্দুল আলীমসহ অজ্ঞাত ৪-৫ জন। একপর্যায়ে তাদের দুইজনকে একটি দোকানের ভিতরে নিয়ে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। খবর পেয়ে তাদের দুইজনকে বাঁচাতে গেলে আমাকেও ধাক্কা দিয়ে তারা চলে যায়। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের দুইজনকে বিনাদোষে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এই নির্যাতনকারীদের বিচার চাই।
তরুণ-তরুণীকে নির্যাতনের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই নির্যাতনকারী ইউপি সদস্য আনিচুর রহমান সেটা নিশ্চিত করে চুড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দাউদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভিডিওটি ভাইরাল হলে আমি মোবাইলে ইউপি সদস্যের সঙ্গে কথা বলেছি সত্য ঘটনা জানার জন্য। মেয়ে ও ছেলেটি যদি অন্যায় করেও থাকে তাহলে এভাবে নির্যাতন করা উচিত হয়নি। ইউপি সদস্য আসলেই অন্যায় করেছেন।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আমি ভুক্তভোগী মেয়ে ও ছেলের পরিবারের সদস্যদের ইউনিয়ন পরিষদে আসতে বলেছিলাম। এর সুষ্ঠু বিচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগী কেউ আমার কাছে আসেননি।’
যশোর কোতয়ালী মডেল থানার ওসি তাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। মারধরের ভিডিও দেখে চিহ্নিত একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের আটকের চেষ্টা চলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। যৌন হয়রানির শিকার নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। এটি নির্মূল করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও জরুরি।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও বর্বর মহামারি নারী ও শিশুদের ওপর যৌনসহিংসতা, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বিগত কয়েক বছর ধরে যৌন সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃসংসতার ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬২৫
আপনার মতামত জানানঃ