কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি বয়ে আনবে, না দুর্ভোগ বাড়াবে- তা নিয়ে বোদ্ধা মহলে রয়েছে প্রাঞ্জল বিতর্ক। বিজ্ঞানের দ্রুত উন্নতি মানব জীবনে যে প্রশান্তির পরশ বইয়ে দিয়েছে, তা আরও বেগবান হবে; নাকি মানব সভ্যতাকেই কোনো এক অজানা বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে- এ নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে।
মেশিন যখন মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দেখায়, সেটিই তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তি, সমস্যা সমাধান, মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা, উপলব্ধি, শিক্ষণ, পরিকল্পনা, কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো বা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো সামর্থ্যসম্পন্ন মেশিনই হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মেশিন।
জার্মানির ‘বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর একদল গবেষক মস্তিষ্কের একটি কৃত্রিম ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ তৈরী করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই নেটওয়ার্কের মাত্র একটি নিউরনই মানুষের পুরো মস্তিষ্কের ক্ষমতার সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম। সূত্র: দ্য নেক্সট ওয়েব
আমাদের মানব মস্তিষ্কে ৮৬ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে। এসব নিউরনের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে জগতের সবচেয়ে সেরা প্রাকৃতিক নিউরাল নেটওয়ার্ক। বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্কের নিউরাল গঠনকে অনুকরণ করে নির্মিত হয়েছে, যেখানে অপেক্ষাকৃত ছোট স্থানের মধ্যে সর্বোচ্চ নিউরনকে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়।
এধরনের ডিজাইনে প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে, এরকম মস্তিষ্কে উৎপাদিত ফলাফল মানব মস্তিষ্কের তুলনায় কম দক্ষতাসম্পন্ন। ‘দ্যা রেজিস্টার্স কাতিয়ানা কোয়াচে’র তথ্যানুযায়ী এমন একটিমাত্র ‘সুপার নেটওয়ার্কে’র পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য একটি মহাকাশ মিশনের মতো খরচ হতে পারে।
বিজ্ঞানীদের মতে, ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং এটির সাথে সংশ্লিষ্ট হার্ডওয়ারগুলো কাজ করার জন্য বৃহৎ ডেটা সেট ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসাবে ‘জিপিটি-৩’ এর কথাই ধরা যাক। জিপিটি-৩’ এর ১৭৫ বিলিয়ন প্যারামিটার রয়েছে। যা ‘জিপিটি-২’ এর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি। কার্বনট্র্যাকারের গবেষণা মতে, ‘জিপিটি-৩’ মাত্র একবার পরিচালনা করতে যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় করতে হয় তা দিয়ে ডেনমার্কের ১২৬ টি বাসা-বাড়িতে টানা এক বছর প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব’।
জার্মানির ‘বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর একদল গবেষক মস্তিষ্কের একটি কৃত্রিম ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক’ তৈরী করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই নেটওয়ার্কের মাত্র একটি নিউরনই মানুষের পুরো মস্তিষ্কের ক্ষমতার সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম।
জিপিটি-৩’ এর মতো গতানুগতিক নিউরাল সিস্টেমে প্রতিটি নিউরন একটি করে ফলাফল তৈরী করে। যত বেশি নিউরন হবে, ততোবেশি প্যারামিটার তৈরী হবে। আর, যতোবেশি প্যারামিটার হবে, তত সূক্ষ্ম ফলাফল তৈরি করা সম্ভব হবে।
কিন্তু, গবেষকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, নির্দিষ্ট স্থানের উপর বিভিন্ন ওজনের নিউরন ছড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সময়ের সাথে একই নিউরনকে ভিন্নভাবে ওজন করলেও একই কাজ সম্পন্ন করতে পারে। ‘বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর একটি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ‘এটিকে বৃহৎ ডাইনিং টেবিলে বসা একজন ব্যক্তির সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যিনি সময়ের সাথে স্থান পরিবর্তন করে নিজেই প্রশ্নত্তোর সম্পন্ন করছেন’।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে কি বোঝায়? গবেষকদের মতে, একে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরীর জন্য ক্রমবর্ধমান শক্তি খরচের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমরা জানি, সময়ের সাথে বড় নেটওয়ার্কগুলোর জন্য দ্বিগুণ বা তিনগুণ শক্তি ব্যবহার অব্যাহত রাখলে খুব দ্রুতই আমাদের মজুদকৃত শক্তি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আসল প্রশ্নটি হচ্ছে, সময়ের আবর্তে আটকে থাকা একটি নিউরন কোটি কোটি ফলাফল দিতে পারে কিনা।
প্রাথমিকভাবে ‘কম্পিউটারের ভিশন ফাংশন’ পরীক্ষা করার জন্য গবেষকেরা নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। এটি একটি সঠিক ছবি তৈরি করার জন্য একটি পোশাকের ছবি থেকে বাইরের শব্দ অপসারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এটিকে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য উন্নত ধাপ বলেই বিবেচনা করা হয়।
পরবর্তীতে এটিকে উন্নত করার মাধ্যমে গবেষকেরা মনে করেন, সিস্টেমটি সময়ের সাথে স্থির কোনো নিউরনকে ‘অসীম সংখ্যক নিউরনের সংযোগ তৈরি করতে’ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এবং এটাও সম্ভব যে, এই ধরনের একটি সিস্টেম মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নিউরাল নেটওয়ার্কে পরিণত হতে পারে, যাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞরা ‘সুপার ইন্টেলিজেন্স’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকৃত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন হয়ে উঠেছে একটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র যেখানে পড়ানো হয় কিভাবে কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার তৈরি করতে হয় যা বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করবে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে।
কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয় যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মত ভাবতে পারে। যেমন শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হল মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, এআই গবেষণার ক্ষেত্রটি “বুদ্ধিমান এজেন্ট” -এর অধ্যয়ন হিসাবে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে: যে কোনও যন্ত্র যা তার পরিবেশকে অনুধাবন করতে পারে এবং এমন কিছু পদক্ষেপ নেয় যা কিছু লক্ষ্য অর্জনে তার সাফল্যকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নেয়।
“কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” শব্দটি প্রয়োগ করা হয় তখন যখন একটি মেশিন “জ্ঞানীয়” ফাংশনগুলিকে কার্যকর করে যা অন্যান্য মানুষের মনের সাথে মিল থাকে, যেমন “শিক্ষা গ্রহণ” এবং “সমস্যা সমাধানের” সাথে সংযুক্ত।
আন্দ্রেয়ার কাপলান এবং মাইকেল হেনলিন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংজ্ঞায় বলেন “এটি একটি সিস্টেমের বহির্ভূত তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষমতা, এমন তথ্য থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ঐ শিক্ষা ব্যবহার করে নমনীয় অভিযোজনের মাধ্যমে বিশেষ লক্ষ্য করা।”
মেশিনগুলি ক্রমবর্ধমানভাবে সক্ষম হয়ে উঠে তখন মানসিক সুবিধার জন্য বুদ্ধিমত্তাকে সংজ্ঞা থেকে সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, অপটিক্যাল অক্ষর স্বীকৃতিটি “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার” উদাহরণ হিসাবে আর অনুভূত হয় না, তখন এটি একটি রুটিন প্রযুক্তি হয়ে ওঠে। বর্তমানে যে সক্ষমতাগুলোকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি মানুষের বক্তব্যকে সফলভাবে বুঝতে পারে, কৌশলগত গেম সিস্টেম (যেমন দাবা এবং যাওয়া) উচ্চতর স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালাতে পারে, সামরিক সিমুলেশন এবং জটিল উপাত্ত ব্যাখ্যা করতে পারে।
এআই গবেষণাকে কতগুলো উপ শাখায় বিভক্ত করা যেতে পারে যা নির্দিষ্ট সমস্যা, দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ সরঞ্জামের ব্যবহার বা নির্দিষ্ট অ্যাপ্লিকেশনগুলির সন্তুষ্টির দিকে ফোকাস করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামগ্রিক গবেষণার লক্ষ্য হচ্ছে প্রযুক্তি তৈরি করা যার মাধ্যমে কম্পিউটার এবং মেশিনগুলি বুদ্ধিমান পদ্ধতিতে কাজ করতে সক্ষম হবে। বুদ্ধিমত্তার উত্পাদন (বা তৈরি) সাধারণ সমস্যাগুলোকে কয়েকটি উপ সমস্যায় বিভক্ত করা হয়েছে। যে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলি বা ক্ষমতাগুলি রয়েছে তা গবেষকরা একটি বুদ্ধিমান সিস্টেম প্রদর্শন করবে বলে আশা করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৫
আপনার মতামত জানানঃ