যুদ্ধ মানে শুধুই যুদ্ধরত দেশের মানুষের ক্ষতি এমন নয়। কোথাও যুদ্ধ বাধলে সেই প্রভাব গিয়ে পড়তে পারে হাজার মাইল দূরের কোনো দেশের মানুষের উপরও। চলমান ইউক্রেন রাশিয়া সংঘাত নিয়ে এমন নানা সংকটের সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য ঝুঁকি। তথ্য মতে এ দুটি দেশ বিশ্বে যব সরবরাহের ১৯ শতাংশ, গমের ১৪ শতাংশ ও ভুট্টার চার শতাংশ জোগান দেয়। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্য রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসে রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। তাছাড়া, রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম সার সরবরাহকারীও বটে। এক বিবৃতিতে এ সতর্কবার্তা দিয়েছে এফএও।
গত বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ন্যায়সঙ্গত প্রবৃদ্ধি, অর্থ ও প্রতিষ্ঠান) ইন্দারমিট গ্রিল জানান, কিছু উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশ খাদ্যের জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশ তাদের আমদানি করা গমের ৭৫ শতাংশেরও বেশি নেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। সংঘাতের কারণে দেশগুলো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করতে পারছে না। খাদ্য পরিবহনও ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে, তৈরি হতে পারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।
খাদ্যের দাম বাড়তে পারে ২০ শতাংশ
গত ১১ মার্চ এ সংকট নিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তারা বলেছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে ফসল চাষ অনিশ্চিত ও নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার খাদ্য রপ্তানিতে সংশয় উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এফএও মহাপরিচালক কিউ ইউ ডং আশঙ্কাপ্রকাশ করে বলেন, এসব পণ্যের প্রধান দুই রপ্তানিকারকের কৃষিকাজে ব্যাঘাত বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
কৃষি বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেনের অনুপস্থিতিতে তৈরি ঘাটতির সামান্য অংশই অন্য দেশগুলো পূরণ করতে পারবে বলে মনে করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। তাদের মতে, এই সংকট বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পশুখাদ্যের দাম আট থেকে ২২ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারে।
কমে যাবে রেমিট্যান্স তৈরি হবে জ্বালানি সংকটও
১০ মার্চের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মি. গ্রিল আরো বলেন, রাশিয়া জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের বাজারেও একটি প্রধান শক্তি। এটি প্রাকৃতিক গ্যাসের বাজারের এক চতুর্থাংশ, কয়লার বাজারের ১৮ শতাংশ, প্ল্যাটিনামের বাজারের ১৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলের বাজারে ১১ শতাংশ জোগান দেয়। এই পণ্যগুলোর সরবরাহে বিরাট প্রভাব পড়েছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও কমিয়ে দেবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রকাশনা থেকে অনুমান করা হয়েছে, তেলের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে। এটা চলতে থাকলে পণ্য-আমদানিকারী উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে প্রবৃদ্ধি হতাশাজনকভাবে কমবে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতসহ নানা কারণে গত ৬ মাসে তেলের দাম ১০০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। যদি এটি স্থায়ী হয় তবে চীন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তুরস্কের মতো তেল আমদানিকারক দেশগুলোতেও প্রবৃদ্ধি কমবে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ২ শতাংশ, তুরস্ক ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং চীন ও ইন্দোনেশিয়া ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সংঘাতের কারণে দেশগুলো প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে না।
গ্রিল বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ২০ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে বৃহত্তম গণ-অভিবাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার আশঙ্কা করছে খুব দ্রুত শরণার্থীর সংখ্যা ৪০ লাখে পৌঁছাবে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আকস্মিক আগমনকে মেনে নেওয়া আয়োজক সরকারের জন্য কঠিন। এটি জনসাধারণের অর্থায়ন এবং পরিষেবা সরবরাহের ওপর চাপ সৃষ্টি করে- বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিজ্ঞপ্তিতে তিনি আরো জানান, অর্থনৈতিক মন্দা পূর্ব ইউরোপের বাইরের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেসব দেশ প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে। মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়া থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল- কিছু ক্ষেত্রে, এই রেমিট্যান্স দেশের জিডিপির ১০ শতাংশের মতো। মধ্য এশিয়ার অনেক দেশে সংঘাতের ফলে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু খাদ্য ও জ্বালানি নয় আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। যার অন্যতম কারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ। মার্কিন মুলক ও ইউরোপ থেকে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসছে রাশিয়ার উপর। আবার কে কার পক্ষে কথা বলেছে বা বলেনি কিংবা চুপ থেকেছে তার উপর নির্ভর করে পরিবর্ন হচ্ছে পূর্ করা আমদানি রফতানি চুক্তি। ইউক্রেনে রুশ হামলার নিন্দা ও সৈন্য প্রত্যাহারে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রেজ্যুলেশনের পক্ষে ভোট না দেয়ায় বাংলাদেশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ভ্যাকসিন না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে লিথুয়ানিয়া।
ইউরোপীয় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র রাসা জাকিলাইটিয়েনে জানিয়েছেন, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকার পর লিথুয়ানিয়া বাংলাদেশকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে লিথুয়ানিয়া সরকার ফাইজারের তৈরি চার লাখ ৪৪ হাজার ৬শ’ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠানোর কথা ছিল।
বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে অনতিবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। ওই রেজ্যুলেশন বিষয়ে জাতিসংঘে দুইদিন উন্মুক্ত আলোচনা এবং বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। সেই আলোচনায় জাতিসংঘে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত রাশিয়াকে গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ ভোটে জাতিসংঘে ওই রেজ্যুলেশন পাস হয়। এমন আরো কতো নিত্য নতুন সমস্যায় পরতে হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৭
আপনার মতামত জানানঃ