ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলির সমালোচনার মুখে রাশিয়া। এই কঠিন সময়ে বন্ধু মস্কোর পাশে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে জানান দিল বেইজিং।
কোনও রকম রাখঢাক না করেই চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই আজ জানিয়েছেন, চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব অত্যন্ত ‘দৃঢ়’।
মাসখানেক আগে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৈঠকে বসেছিলেন। সেই বৈঠকে দুই রাষ্ট্রনেতা জানিয়েছিলেন, দু’দেশের বন্ধুত্ব ‘শর্তহীন’।
চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই আজ বার্ষিক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘রাশিয়া এবং চীনের বন্ধুত্ব অত্যন্ত দৃঢ়। দুই দেশের ভবিষ্যৎ সহযোগিতার সম্ভাবনা বিপুল। চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক বিশ্বের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক।’’
তিনি জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক বেইজিং। তার কথায়, ‘‘শান্তি স্থাপনে বিশ্বের অন্য দেশগুলির সঙ্গে আমরা কাজ করতে চাই। প্রয়োজন হলে মধ্যস্থতা করতেও আপত্তি নেই।’’
মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে চীনকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশ বিষয়ক বিভাগের প্রধান জোসেফ বোরেল গত সপ্তাহেই বলেছিলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে চীনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়া উচিত। একই মত অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনেরও।
তিনি বলেছেন, ‘‘চীন বহু দিন ধরেই দাবি করে আসছে বিশ্বের শান্তি ও স্থায়িত্ব রক্ষায় তাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। তা হলে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে চীন মধ্যস্থতা করুক।’’
এদিকে, ২২টি কূটনৈতিক মিশনের প্রধান গত ১ মার্চ চিঠি লিখে পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, ইসলামাবাদ যেন রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। কাল তা নিয়ে সরব হয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আপনাদের ক্রীতদাস… যা বলবেন তাই করব?’’ রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত ছিল ইমরানের দেশ।
পাক প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্ন, ‘‘ভারতকে আপনারা এই ধরনের চিঠি লিখতে পারবেন?’’ ইমরান জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে তাঁদের বন্ধুর সম্পর্ক, তারা আমেরিকারও বন্ধু। পাকিস্তান কোনও শিবিরভুক্ত নয়।
আর্থিক নিষেদ্ধাজ্ঞা এড়াবে যেভাবে
ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পরই নতুন করে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়েছে রাশিয়া। সে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সংস্থা, শিল্পপতি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে পৃথিবী এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের কবলে নেই—আর্থিক ব্যবস্থাও এখন আর নিছক ডলার ও সুইফট-নির্ভর নয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবর্তিত ডিজিটাল মুদ্রার কল্যাণে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা পাশ কাটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপানসহ একাধিক দেশ ইউক্রেন সংকটের জেরে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পপতির সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি দেশ রাশিয়ান পর্যটকদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কিন্তু তাতে প্রাথমিকভাবে কিছুটা অসুবিধায় পড়লেও বিটকয়েনকে হাতিয়ার করে রাশিয়ার নাগরিকদের অনেকেই সেই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সক্ষম হবেন বলে মনে করছে ডিজিটাল মুদ্রা বিশারদদের একাংশ।
আবার এই সুযোগে চীনা লেনদেনব্যবস্থা সিআইপিএস ও তাদের ডিজিটাল ইউয়ান বিকল্প মুদ্রা হয়ে উঠতে পারে—এমন সম্ভাবনাও প্রবল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ডিজিটাল মুদ্রা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতিমধ্যে রাশিয়ার নাগরিকদের মধ্যে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের প্রবণতা বেড়েছে, ভবিষ্যতের ঝুঁকি এড়াতে তারা বিটকয়েনের ওপর নির্ভর করছেন। যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্যা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত।
কয়েক মাস আগে সেই দেশের অর্থ দপ্তরের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, ডিজিটাল মুদ্রা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা হ্রাস করছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে প্রথাগত আর্থিক ব্যবস্থার বাইরে তহবিল সঞ্চয় ও স্থানান্তর করতে না পারে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের কথাও বলা হয়েছিল ওই সতর্কবার্তায়।
চীন ক্রস বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস) গড়ে তুলেছে। এখন রাশিয়ার ব্যাংকগুলোও সিআইপিএসকে সুইফটের বাস্তবসম্মত বিকল্প হিসেবে ভাবছে। সিআইপিএসের গুরুত্ব বৃদ্ধির ঘটনায় ধারণা করা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার রুবলের চেয়ে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
তবে সুইফটের বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য স্থান দখল করতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সিআইপিএসকে। আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের ব্যবহার ২ শতাংশের কম, মার্কিন ডলারের ব্যবহার ৪০ শতাংশ। এমনকি ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড কিংবা জাপানি মুদ্রা ইয়েনের তুলনায়ও পিছিয়ে আছে ইউয়ান।
তবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, কম ব্যবহার সত্ত্বেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সুইফটের আঞ্চলিক বিকল্প হয়ে উঠতে পারে সিআইপিএস। যেমন ইউরেশিয়া অঞ্চলে এর একক ব্যবহার শুরু হতে পারে। এ ছাড়া সিআইপিএসের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা বাড়ছে। সম্প্রতি রাশিয়ার ২৩টি ব্যাংক সিআইপিএস ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে—বিপরীতে কেবল ব্যাংক অব চায়না রাশিয়ার এসপিএফএস ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে। তাই বড় প্রশ্ন হচ্ছে, সুইফটের বিকল্প হতে চীন কি রাশিয়ার এসপিএফএসকে সঙ্গে নিয়ে এগোবে, নাকি নিজেরাই এককভাবে সিআইপিএসের প্রসার ঘটাতে চাইবে।
ডিজিটাল মুদ্রা
ডিজিটাল মুদ্রা ইন্টারনেটভিত্তিক মুদ্রা, যার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো বিটকয়েন। তবে এটি বেসরকারি। সরকারি ডিজিটাল মুদ্রাও আছে পৃথিবীতে, যেমন ডিজিটাল ইউয়ান। এই ডিজিটাল ইউয়ানের জোরে চীন আন্তর্জাতিক লেনদেনে সুইফটের বিকল্প হিসেবে সিআইপিএসকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ডিজিটাল মুদ্রার যুগে গ্রাহককে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে হিসাব খুলতে হবে না, বরং তারা সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করবেন। মাঝখানে থাকবে আলি পে বা ভেনমোর মতো অ্যাপ। চেক লেখা বা অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অর্থ পরিশোধ করার বদলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরবরাহ করা ডিজিটাল মুদ্রায় সরাসরি লেনদেন হবে তখন। ফলে তখন আর সুইফটের প্রয়োজন হবে না।
তবে এই উত্তরণ অত সহজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য করতে হবে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশকে। তাই পশ্চিমাদের শর্ত মানতে হবে তাদের। ফলে পৃথিবী একমেরু বা দ্বিমেরু ব্যবস্থা থেকে বহুমেরু ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা, যেখানে সুইফটের সঙ্গে সিআইপিএসের নামও উচ্চারিত হবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ