নারী দিবস। নারী অধিকার নিয়ে বিস্তর আলোচনার ফাঁকে বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পর্যাপ্ত পদক্ষেপের অভাব গোটা নারী অধিকারকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। বাল্যবিবাহের সংকট বড় হলেও তা মোকাবিলায় খুব কমই নজর দেওয়া হচ্ছে। করোনাকালে এ সংকটকে আরও গুরুতর হয়েছে।
দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে অসংখ্য কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব নিয়ে সরকার জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এএনপি) তৈরি করেছে বেশ আগেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে যুক্ত করা হয়েছে ২৫টি মন্ত্রণালয়কে।
অথচ উন্নয়ন সংস্থা, অধিকারকর্মী ও গবেষকদের মতে, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, প্রস্তাবিত কার্যক্রমের সঙ্গে বাজেট বরাদ্দের ফারাক, সময় গড়িয়ে গেলেও প্রস্তাব বাস্তবায়নে উদ্যোগ না নেওয়া, সর্বোপরি তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি স্পষ্ট করছে, বাল্যবিবাহ নির্মূলের বিষয়টি সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই।
করোনাকালে বাল্যবিবাহ
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবরে ২১ জেলার ৮৪টি উপজেলায় ‘র্যাপিড অ্যানালাইসিস অব চাইল্ড ম্যারেজ সিচুয়েশন ডিউরিং কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের জরিপে ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহের তথ্য পাওয়া যায়।
মেয়েদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বয়স ১৬–১৭ বছর, ৪৮ শতাংশের ১৩–১৫ বছর এবং ২ শতাংশের বয়স ১০–১২ বছর ছিল। বাল্যবিবাহ বেশি হয়েছে বরগুনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লক্ষ্মীপুরে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫১ শতাংশের ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়। ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয় ১৫ শতাংশের।
সায়মা হকের গবেষণায় এসেছে, সবচেয়ে বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জে (৭২ শতাংশ) এবং সবচেয়ে কম সিলেটে (২৫ শতাংশ) বাল্যবিবাহের প্রবণতা রয়েছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ফোন পেয়ে ৮ হাজার ২৫৪টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুসারে, প্রায় ১৪ হাজার বাল্যবিবাহের মধ্যে ৫ হাজার ৮৯টি মেয়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণের শিকার হয়েছে।
এই সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ না হলে মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমবে, স্বাস্থ্যঝুঁকি কমে কাজ করতে সক্ষমতা বাড়বে, হাসপাতালের খরচ কমবে। এসব বিবেচনায় একটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আর্থিক ক্ষতি কমানো সম্ভব আনুমানিক ৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের ফারাক
২০১৪ সালের ২২ জুলাই লন্ডন গার্লস সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ নির্মূল এবং ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহ এক–তৃতীয়াংশ কমানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূলের অঙ্গীকার করেন। এরপরই ২০১৮ সালকে ভিত্তি ধরে স্বল্প (২০১৮-২১), মধ্য (২০১৮-২৫) এবং দীর্ঘ মেয়াদে (২০১৮-৩০) মোট ২৩৫টি কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে এএনপি ঘোষিত হয়।
বিভিন্ন বেসরকারি তথ্য–উপাত্ত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ কমানোর লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়নি।
বাল্যবিবাহ নির্মূলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে প্রধান করে ২৯ সদস্যের জাতীয় কমিটি ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি গঠিত হয়। কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি আছেন। গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রথম এ কমিটির বৈঠক হয়। পারস্পরিক সমন্বয়হীনতার অভাবে ওই বৈঠকে বাল্যবিবাহ নির্মূলে কাজের কোনো অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরতে পারেনি মন্ত্রণালয়গুলো। স্বল্প মেয়াদে শুধু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ১৬৯টি প্রস্তাবিত কার্যক্রম রয়েছে, যার কোনোটিই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ২০২১-২২–এর বাজেট বরাদ্দের শীর্ষ মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের জন্য ভূমিকা রাখবে এমন তিন মন্ত্রণালয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নেই।
সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির তিনটি অর্থবছর ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১–এর দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দের ১ শতাংশের কম রাখা হয়েছে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সবচেয়ে বেশি কার্যক্রম থাকা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুসারে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেদের বিয়ের জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক ধরা হয়েছে। বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে, বিশেষ বিধানের আওতায় প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ