দেশের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নির্যাতনের খবরে শিউরে উঠছে সারা দেশ। যদিও মাদ্রাসাগুলোতে ক্রমবর্ধমান এই ধর্ষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারের। দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরব নয়। নেই বার্ষিক কোন প্রতিবেদন। তাই এই সব নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র থেকে যাচ্ছে অজানা।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের পর শিক্ষার্থীরা লজ্জা, ভয়, নানান কিছুর কারণে তা প্রকাশ করে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সবথেকে কম কথা বলা হয়। এর কারণ হয়তো সেক্স, অপ্রাপ্তবয়স্ক ভুক্তভোগী এবং ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে মানুষের অন্ধবিশ্বাস।
এরই ধারাবাহিকতায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে বাঁশঝাড়ে ফেলেছে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোরসালীন। বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) বিকালে গাইবান্ধা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি (শনিবার) সকালে প্রতিদিনের মতো বাড়ি থেকে মোক্তবে আরবি পড়তে যায় ওই শিশু। পড়া শেষ হলে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোরসালীন শিশুটির হাতে ১০ টাকার নোট দিয়ে বিস্কুট আনতে দোকানে পাঠায়। বিস্কুট নিয়ে আসার পর তাকেসহ মোক্তবে থাকা আরও দুই শিশুকে বিস্কুট খাওয়ায়। সকাল ৯টার দিকে মোরসালীন শিশুটিকে ডেকে মসজিদের পাশে তার থাকার টিনশেডের ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে ধর্ষণের চেষ্টা করলে শিশুটি বাধা দিয়ে নানিকে বলে দেবে বলে জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গলা চিপে ধরলে শিশুটি নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ সময় শিশুটিকে ধর্ষণ করে। এরপরর পরনে থাকা হিজাব গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ বস্তায় ভরে বাঁশঝাড়ে ফেলেছে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোরসালীন।
পুলিশ সুপার জানান, হত্যার পরপরই মসজিদে থাকা বালুভর্তি বস্তা খালি করে মোরসালীন লাশ বস্তা ঢুকিয়ে বেলা ১১টার দিকে নিজের বাইসাকেলের ক্যারিয়ারের পেছনে বস্তা বেঁধে দুই কিলোমিটার দূরের বর্ধন কুঠি এলাকায় নিয়ে যায়। বস্তাটি মানিক কাজীর বাঁশঝাড়ে ফেলে। এরপর খোঁজাখুঁজি করেও শিশুটির সন্ধান না পেয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি জিডি করে পরিবার। পরদিন স্থানীয়রা বাঁশঝাড়ে বস্তাভর্তি লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। শিশুটির বাড়ি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাখালবুরুজ ইউনিয়নে। কিছুদিন ধরে শিশুটি মায়ের সঙ্গে তার নানার বাড়িতে থাকতো।
পুলিশ সুপার তৌহিদুল ইসলাম আরও জানান, হত্যার রহস্য উন্মোচন ও জড়িতের শনাক্তে মাঠে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তদন্তে একটি দোকানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে সাইকেলের পেছনে বস্তা নিয়ে যেতে দেখা যায় মোরসালীনকে। পরে ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেফতার করলে শিশুটিকে হত্যা কথা স্বীকার করে। তার কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত বস্তা, বাইসাইকেলসহ গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। মোরসালীন নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার জাহিদুল ইসলামের ছেলে। মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করায় গোবিন্দগঞ্জে থাকতো।
এ ছাড়া হত্যায় জড়িত সন্দেহে আরাফাত, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও আল-আমিন নামে গ্রেফতার তিন জনের বিরুদ্ধেও তদন্ত সাপেক্ষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
বাংলাদেশে এখন ছেলে শিশু ধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বড়ে গেছে৷ কিন্তু ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়ার তেমন কোনো নজির দেখা যায় না। প্রায় সমস্তটাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা মাতব্বর কর্তৃক শালিসে বিচারের মাধ্যমে সুরাহা করা হয়। তবে এবিষয়ে আইনে সুস্পষ্টভাবে তেমন কিছু নেই বলে অনেকে দাবি করলেও আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, একটা ভুল ধারণা চলে আসছিল যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শুধু নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হলেই বিচার করা যাবে৷ কিন্তু এই আইনের সংজ্ঞায় শিশু বলতে ছেলে বা মেয়ে আলাদা করা হয়নি৷ ১৬ বছর পর্যন্ত সব শিশুকেই বুঝানো হয়েছে৷ শিশু আইনেও শিশুদের কোনো লিঙ্গ ভাগ করা হয়নি৷ তাই ১৬ বছর পর্যন্ত কোনো ছেলে শিশু যদি ধর্ষণের শিকার হয় তাহলে ধর্ষণ মামলাই হবে৷ যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া অন্য মাদ্রাসাগুলোতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকি সেভাবে নেই। সেজন্য যৌন নির্যাতন বা শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সুযোগ থাকে। এছাড়া সেখানে পরিবেশ এমন যে, শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ অনেক সময় প্রকাশও হয় না। কওমি, এবতেদায়ী বা নূরানী-বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে কর্তৃপক্ষ যারা রয়েছে, তাদের তদারকি বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকে মনে করেন এরা আদব কায়দা শিক্ষা দেন। নৈতিকতা শিক্ষা দেন। সে কারণে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে হোক বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেকে ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পড়াতে দেন। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, যে নিরাপত্তার কথা ভেবে মাদ্রাসায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে দেয়া হয় সেখানে আদৌ নিরাপদ নয়। দেখা যায় ছেলেরাও নিরাপদ নয় এসব তথাকথিত হুজুরদের কাছে। এটিও সমাজের বৈকল্যতা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ