ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে দেখা হবে অনেকটা এরকম- বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সামরিক বাহিনী বিনা প্ররোচনায় প্রতিবেশী একটি দেশের ওপর স্থল আক্রমণ করেছে। দখলের মাধ্যমেই হোক বা পুতুল সরকার বসানোর মাধ্যমেই হোক এই হামলার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য সম্ভবত আঞ্চলিক আধিপত্যের বিস্তৃতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধরনের সংঘাত আরও দেখা গেছে। ১৯৫০ এর দশকে হাঙ্গেরিতে, ১৯৬০ এর দশকে চেকস্লোভাকিয়ায় এবং ১৯৭০ এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন; এমনকী ২০১৪ সালে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের ক্রিমিয়া দখলও এর মধ্যে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রও কম যায়নি; তারা ১৯৮০-র দশকে পানামায় হামলা চালিয়েছে, সিআইএ-কে ব্যবহার করে ১৯৫০ এর দশকে গুয়াতেমালার, ৭০ এর দশকে চিলির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে। দূরে গিয়েও তারা অনেকগুলো যুদ্ধ করেছে, যেমন ইরাকে, আফগানিস্তানে, ভিয়েতনামে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে বিরল ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের সীমানা বাড়াতে বা তাদের অঞ্চলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে নির্ভরশীল দেশ বানাতে দেখা গেছে। জশুয়া গোল্ডস্টেইন, স্টিভেন পিনকার ও অন্যান্য পণ্ডিতদের হিসাবে এই শতকের শুরুর দিকেই সশস্ত্র সংঘাতে মানুষের মৃত্যুর হার জানা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়; এক্ষেত্রে যুদ্ধ কমে যাওয়াই প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে এমন ধরনের যুদ্ধ হতে পারে, যা একসময় সাধারণ ঘটনা হলেও গত ৮০ বছরে খুব একটা দেখা যায়নি। এটি হবে সেই ধরনের যুদ্ধ, যেখানে শক্তিশালী একটি দেশকে আঞ্চলিক আধিপত্য বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবেশী একটি দেশকে দখলে নিতে হচ্ছে।
ইউক্রেন হামলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল প্রায় এক মাস আগেই। সামরিক মহড়ার নামে বেলারুশে রুশ সেনার প্রবেশের পরেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল আমেরিকা-সহ পশ্চিমী দুনিয়া। গত করেক দিনে বেলারুশ-ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সেনার গতিবিধি বলছে, পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হলে দ্রুত ‘তৃতীয় ফ্রন্টলাইন’ খুলতে অসুবিধা হবে না ভ্লাদিমির পুতিনের। ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেনের মতোই স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হয়েছিল বেলারুশ। কিন্তু গোড়া থেকেই সেখানকার সরকার মস্কো-ঘনিষ্ঠ।
বৃহস্পতিবার ভোরে পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান ঘোষণার পরেই সীমান্তে সক্রিয় হয়েছে রুশ সেনারা। সোমবার রাতে পুতিন ইউক্রেনের ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
ইতিমধ্যেই সেখানে রুশ সেনার অনুপ্রবেশের খবর মিলেছে। ওই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ রুশ। মস্কো-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলিও সেখানে সক্রিয়। তাদের সাহায্যে এই এই অঞ্চল থেকেই রুশ সেনা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অভিযান শুরু করতে পারে বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে।
পুতিনের আসল লক্ষ্য কী; সেটি শক্ত প্রশ্ন হলেও তার আপাতত লক্ষ্যটা পরিষ্কার। সেটি হলো তিনি প্রথমত ও প্রধানত চান ইউক্রেন কস্মিনকালেও ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। এমনকি পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হোক, তা–ও তিনি চান না। তিনি চান, যেকোনো মূল্যে পশ্চিমাদের সঙ্গে ইউক্রেনের গলায়-গলায় খাতির জমানোর চেষ্টাকে নস্যাৎ করতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, পুতিন শুধু দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক দখল করে শান্ত হবেন, তা মনে করার কারণ নেই। তাদের ধারণা, পুতিন এই দুটি জায়গায় নিজের সেনাবাহিনী প্রথমে সংহত করবেন। ধীরে ধীরে দখল সম্প্রসারণ করবেন এবং এমনকি কিয়েভও দখল করে নিতে পারেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়া উপদ্বীপের আশপাশের সমস্ত কাস্পিয়ান উপকূল তিনি দখলে নেবেন।
পশ্চিমাদের কেউই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার হাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলছে না। একইভাবে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় পুতিন একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তিনি গোটা ইউক্রেনকেই গিলে ফেলার নির্দেশ দিয়ে দিতে পারেন। তবে সে ধরনের নির্দেশ এলে তা দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের ফুলকি ছড়িয়ে দিতে পারে।
পশ্চিমারা প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা কমানো এবং পশ্চিমা ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে মস্কোকে বাদ দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রত্যাঘাত হিসেবে পুতিন ইউরোপিয়ান অঞ্চলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারেন (সেই জ্বালানি চীনে সরবরাহ করার আশা করে ক্রেমলিন) এবং পশ্চিমা শিল্পগুলোতে সাইবার হামলা চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন।
এমন হুমকি এবং প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার বিষয়ে ন্যাটোভুক্ত মিত্ররা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কতটা দৃঢ়, তা এক বড় প্রশ্ন। অতীতে ইউক্রেনের ভাগ্য বিনির্মাণে তাদের আগ্রহ ছিল খুবই ক্ষীণ। ২০০৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি সেই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিল।
জার্মানি ও ইতালি উভয়ই রাশিয়ার কাছ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনে থাকে। ফ্রান্সের সঙ্গে তারাও রাশিয়ার সঙ্গে টক্করে না গিয়ে আলোচনার পক্ষে। অর্থাৎ পুতিনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সেই ইস্যুতেই ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যেই মতবিরোধ আছে। আর এটিকেই পুতিন সবচেয়ে বড় সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন।
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় গ্যাস কোম্পানি গ্যাসপ্রোম। দীর্ঘদিন ধরে তারা ইউরোপে কার্যত একচেটিয়ে ব্যবসা করছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গোটা ইউরোপে যে পরিমাণ গ্যাসের ব্যবহার হয়, তার ৪৩ শতাংশ গ্যাসপ্রোমের। রাশিয়া থেকে পাইপলাইনের সাহায্যে যা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া যদি ইউরোপে গ্যাস সাপ্লাই একদিনের জন্যও বন্ধ করে দেয়, তাহলে প্রবল সমস্যায় পড়বে ইউরোপ।
পূর্ব ইউরোপ প্রায় পুরোপুরি রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। পশ্চিম ইউরোপে অবশ্য নরওয়ে, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা থেকেও গ্যাস আসে। তবে সেখানেও রাশিয়ার গ্যাসের ভালোই প্রয়োজন হয়। রাশিয়ার গ্যাসের পুরোটাই আসে গ্যাসপ্রোমের মাধ্যমে। গ্যাসপ্রোমে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী কাজ করেন। এর মালিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের অত্যন্ত কাছের বন্ধু। এই কারণেই গ্যাস নিয়ে চিন্তায় ইউরোপ।
বস্তুত, মাসকয়েক আগে জার্মানির সঙ্গে নর্ডস্ট্রিম ২ পাইপলাইনের চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে রাশিয়ার। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ওই গ্যাসলাইন চালু হলে জার্মানি আরো বেশি রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
রাশিয়া বরাবরই গ্যাস এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করে। রাশিয়া জানে, যা-ই ঘটুক না কেন, ইউরোপকে তার কাছ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ নিতেই হবে। ফলে কূটনৈতিক স্তরে এর গুরুত্ব যথেষ্ট। ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর ন্যাটোও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বিভিন্ন দেশকে বিকল্প সন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিকল্প খুঁজলেও রাশিয়াকে একেবারে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।
এটি সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, রাশিয়াকে উত্তেজিত করে তোলার বিষয়ে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের মত নেই। যেহেতু যুক্তরাজ্য ছাড়া বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশই পুতিনের প্রতি আপসকামী মনোভাব দেখানোয় বেশি আগ্রহী, সেহেতু এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র পুতিনের সঙ্গে পেরে উঠবে না। এটি যত স্পষ্ট হচ্ছে, পুতিন তত আগ্রাসী হচ্ছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ