১০৯ বছর আগেও ভয়ঙ্কর এক মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল চীনে। ছড়িয়ে পড়েছিল অন্যান্য দেশেও। করোনা ভাইরাসের মতো চীন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল এই রোগের জীবাণু। স্থানীয় মহামারী তো ঘটেছিলই, সেইসঙ্গে পৃথিবী জুড়ে মহামারীর সম্ভবনাও দেখা দিয়েছিল।
না, কোভিড ১৯-এর কথা বলা হচ্ছে না এখানে। ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে, ১৯১১ সালে। চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এক অজানা প্লেগের সংক্রমণ। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছিলেন ‘মাঞ্চুরিয়ান প্লেগ’।
সেবারেও সেই রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত পৃথিবীতেই। উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে না পারলে সেই মহামারী কোন পর্যায়ে পৌঁছাত, সে-কথা কল্পনা করাও কঠিন।
১৯১০ সালের অক্টোবর মাসে চীনের উত্তর-পূর্বে হারবিন শহরে এক অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয় এক যুবক। তারপর দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। ১৯১১ সালের মাঝামাঝি প্রায় ৬৩ হাজার মানুষ এই রোগের শিকার হন।
এদিকে মাঞ্চুরিয়া তখন একটি আন্তর্জাতিক অঞ্চল। একদিকে জাপানের সেনাবাহিনী, অন্যদিকে রাশিয়ার রেল কোম্পানি। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের বহু মানুষও বাস করেন এখানে। ফলে ক্রমশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ল সংক্রমণ।
সংক্রমণ আটকাতে লকডাউন, মাস্ক, কোয়ারেন্টাইন সমস্ত ব্যবস্থাই নেওয়া হল। রেলের পরিত্যক্ত কামরায় তৈরি হল কোয়ারেন্টাইন সেন্টার। কিন্তু সবার আগে যে জিনিসের প্রয়োজন, সেই ওষুধের সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছিল না।
১৯১১ সালেই পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশের সহযোগিতায় শুরু হল চিকিৎসকদের একটি সম্মেলন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির সমস্ত চিকিৎসকরা। সমস্ত দেশের সরকারের নির্দেশ ছিল, চিকিৎসার জন্য যাবতীয় প্রয়োজনে এগিয়ে যেতে হবে চিকিৎসকদের। আর এভাবেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় আটকে দেওয়া গিয়েছিল মাঞ্চুরিয়ান প্লেগের সংক্রমণ।
এখানেই শেষ নয়, প্রায় ৬০০ বছর পর ১৩৩৪ সালে চীনে দেখা দেয় ‘বিউবনিক প্লেগ’ যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে পরিচিত। এ মহামারির জীবাণুও ছিল ‘Yersinia Pestis’ নামক ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুর ও একধরণের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল। উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া, রক্তবমি ও নিউমোনিয়া। সংক্রমিত মানুষের প্রায় ৫০ শতাংশই মারা গিয়েছিল।
শুরুটা চীনে হলেও মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশ পাড়ি দিয়ে ১৩৪৭ সালে প্রথম ইতালির সিসিলি হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। সারা বিশ্বে পঞ্চাশ বছর ধরে এ মহামারির তাণ্ডব চলে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবী থেকে মুছে যায়! তখন বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে কমে ৩০০ মিলিয়নে নেমে আসে।
মৃত্যুভয় ও আতঙ্কে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার আর ধর্মীয় কোন্দলে জড়িয়ে পরে। শ্রমিক সংকটে পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় থেমে যায়। ফলে সমাজে ধনী-গরিবের শ্রেণিবিন্যাস বদলে যায়। অনেক ধনী মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যায়। আবার অনেক গরিব মানুষ ধনী হতে শুরু করে। এভাবে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয় এ মহামারি-পরবর্তী সময়ে।
‘ব্ল্যাক ডেথ’র সময় থেকেই কোয়ারেন্টিন ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত সংক্রামক রোগের মহামারি নিয়ন্ত্রণে কোয়ারেন্টিনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বিশ্বব্যাপী।
এদিকে, মাঞ্চুরিয়ান প্লেগের একশ বছর পেরিয়ে এসে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল পৃথিবীতে। এবারেও সংক্রমণের উপকেন্দ্র চীন। সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাস। আগের চেয়ে সংকট অনেক বেশি। সহযোগিতার সেতু গড়ে উঠছে কি দেশগুলির মধ্যে? বরং যেন একটি প্রতিযোগিতার আবহাওয়াই দেখা যাচ্ছে সব জায়গায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই জাতিগত বৈরিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যেন পুরোপুরি সফল নয়। একশো বছর আগের ইতিহাস থেকে বোধহয় এই একটি জিনিস শেখার আছে আজকের পৃথিবীর। প্রতিযোগিতা নয়, বরং সহযোগিতার মানসিকতাই সংকটের সময় শক্তি জোগায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ