সময়টা ১৯১৬ সাল। ইউরোপের বুকে তখন ঘটে চলেছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এমন বিরাট যুদ্ধ তার আগে দেখেননি কেউই। অসংখ্য যুবক প্রাণ সংশয় নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের সেনাবাহিনীর হয়ে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওই সময়েই অজানা এক ভাইরাসের কবলে পড়েছিল বিশ্ব। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ঘুম মহামারিতে।
অজানা এক ভাইরাস কাবু করেছিল পুরো ইউরোপকে। তখন সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। তার মধ্যেই নতুন এই ভাইরাসের আতঙ্ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ইউরোপ জুড়ে। গবেষণা বলছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে মারা যাওয়া মানুষের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মারা যায় এই মহামারিতে। ১৯১৬ সালে এই মহামারির সাক্ষী হয়েছিল বিশ্ব।
১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১১ নভেম্বর ১৯১৮ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ভাইরাসটি নিউ ইয়র্কেও প্রবেশ করে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছি। তবে অজানা এ রোগের উপসর্গ তেমন ভযঙ্কর ছিল না।
১৯১৬ সালে ভের্ডনের যুদ্ধ ফেরত এক সৈনিকের শরীরে প্রথম এই রোগটির প্রভাব দেখা যায়। সেনাবাহিনীতে কাজ করার কারণেই স্বাভাবিকভাবেই তার শরীরের দক্ষতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু হঠাৎ এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যায় তার ব্যবহারে। কোনো কাজেই যেন আর মন বসছে না। স্থির চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকছেন, অথচ যেন দেখছেন না কিছুই। আর সুযোগ পেলেই ঘুমিয়ে পড়ছেন তিনি। তখন অনেক চেষ্টা করেও আর সেই ঘুম ভাঙানো যাচ্ছে না। এমন ঘটনায় তার পরিবারের লোকজন তো বটেই, চিকিৎসকরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আর কিছুদিনের মধ্যেই দেখা যায়, তিনি একা নন। একই ধরনের অসুস্থতায় ভুগছেন আরো অনেক সৈনিক। তাদের সংখ্যাটা দেখতে দেখতে বেড়েই চলে।
শুধুই ইউরোপ নয়, কিছুদিনের মধ্যেই নিউ ইয়র্কেও এক ব্যক্তির শরীরে ফুটে উঠল অনুরূপ উপসর্গ। চোখের সামনে মারা যেতে লাগলেন সবাই। আর মৃত্যুর কারণ প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই শ্বাসযন্ত্রের পক্ষাঘাত। রোগের উৎস খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন চিকিৎসকরা। অবশেষে ভিয়েনার এক স্নায়ুবিদ, ভন ইকোনমো লক্ষ করলেন এই রোগের প্রকোপ যাদের উপর এসে পড়ছে, তাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। আর এর ফলেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে তাদের শরীরে। সেই ঘুম যে কখন চিরনিদ্রায় পরিণত হচ্ছে, সেকথা টের পাওয়াও যাচ্ছে না।
ইতিহাসের তথ্য অনুসারে, এ রোগে আক্রান্ত পুরোপুরি সচেতন আবার অচেতনও থাকত না। তারা চেয়ারে সারাদিন অবিচ্ছিন্ন এবং নির্বাক হয়ে বসে থাকত। পুরোপুরি শক্তিহীন ছিল তারা। ক্ষুধাবোধও করত না তারা। সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা তাদের কোনো অসুবিধার কথাই বলতে পারেনি। তারা কোনো অনুভূতি প্রকাশের মতো অবস্থাতেও ছিল না।
এই রোগের লক্ষণ ছিল জ্বর, গলা ব্যথা, মাথাব্যথা, অলসতা, ডাবল ভিশন, মানসিক প্রতিক্রিয়াহীন এবং অতিরিক্ত ঘুম। গুরুতর ক্ষেত্রে রোগীরা কোমায় চলে যেতেন। ঘুমের মধ্যেই রোগীরা চোখ অস্বাভাবিকভাবে নড়তে থাকত। এ চাড়াও তারা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে যেত। শরীরের পেশিতে ব্যথা, কাঁপুনি, ঘাড় সোজা রাখতে না পারাসহ আক্রান্তরা জড়বস্তুতে পরিণত হত
জানা যায়, স্লিপিং সিকনেসের কারণে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশটি ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে বলেই ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়া এ রোগের জন্য দায়ী। ধারণা করা হয়, ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গেও এই রোগের ঘনিষ্ঠতা আছে।
ভনের গবেষণার জন্যই এই রোগ ‘ভন ইকোনমো’জ এনসেফেলাইটিস’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর ডাক্তারি পরিভাষায় এই রোগের নাম, ‘এনসেফেলাইটিস ল্যাথার্জিকা’। তবে এর পরেও রোগের প্রকোপ আটকানো যায়নি। মানুষের শরীর থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল বহু কুকুরের শরীরেও। আর ভাইরাস সম্বন্ধে তেমন কোনো ধারণাই তখনও তৈরি হয়নি।
প্রায় ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এই রোগের প্রকোপ চলেছিল। তারপর দেখা যায়, অ্যান্টি-ভাইরাস ওষুধের সাহায্যেই এই রোগ সারিয়ে তোলা যাচ্ছে। তবে এমন বিস্ময়কর অসুখ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এসেছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে যে কত মানুষের প্রাণ নিয়েছে এই রোগ, তার কোনো সঠিক হিসাব বোধহয় নেই।
জার্মান নিউরোলজিস্ট ফেলিক্স স্টার, যিনি ১৯২০ সালে কয়েকশ এনসেফালাইটিস লেদারজিকার রোগীদের পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি তার এপিডেমিস ইন্সেফালাইটিস বইয়ে উল্লেখ করেন, তাদের শরীরে এনসেফালাইটিস লেথারজিকা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছিল। এর প্রাথমিক লক্ষণ ছিল নিদ্রাহীনতা, এরপর মস্তিষ্ক বিভ্রাট এবং পরবর্তী লক্ষণটি ছিল পার্কিনসন-জাতীয় সিনড্রোম।
২০১০ সালে, এনসেফালাইটিস লেদারজিকার সম্পর্কিত ঐতিহাসিক এবং সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনাকালে বলা হয়, ‘আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, এনসেফালাইটিস লেদারজিকার রোগটি এখনও প্যাথলজিকাল ধাঁধা হিসেবে অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ