সম্প্রতি দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বিশ্বের ৪১ ভাগ উভচর এবং ২৬ ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীই এখন চিরবিলুপ্তির ঝুঁকির সামনে৷ গত ৪০ বছর ধরে মানুষ প্রতি মিনিটে গড়ে অন্তত ২ হাজার করে গাছ কাটছে৷ তাহলে প্রতিদিন বিশ্বের বনাঞ্চল থেকে কী হারে গাছ কমছে ভেবে দেখুন! এর পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ এবং উষ্ণায়নও নানাভাবে বাড়াচ্ছে মানুষ৷ এ সব বিষয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বিলুপ্তিতে বড় ভূমিকা রাখছে৷ এর সাথে যুক্ত হয়েছে গবেষণাগারে প্রাণী হত্যা।
আছে ধর্মের নামে পশুহত্যা। ইসলাম ও হিন্দু দুই ধর্মেই আছে এই বিধান। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে কুরবানির আগে গরুগুলোকে বহুদূর (অনেক সময় ভারত থেকে) থেকে পানি ও খাবার ছাড়া হয় হাঁটিয়ে নিয়ে আসা হয়, অথবা ট্রাকে গাদাগাদি করে অবর্ণনীয় দুদর্শার মধ্যে চালান দেওয়া হয়। এমনকি একটি ক্ষেত্রে ভারত সীমান্তের ঐ পার থেকে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে পশুদের ঠেলে গড়িয়ে দেবার ঘটনাও আছে। তাই এর মধ্যে অনেক পশুই গরমে, না খেতে পেয়ে অথবা অন্যান্য অত্যাচারে যাত্রা শেষ হবার আগেই মারা যায়।
ধর্মের নামে প্রাণীহত্যা
পূর্ব ভারতে আসাম, ওড়িশা, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যগুলির পাশাপাশি নেপাল জাতির অনেক শক্তি মন্দিরে পশু বলির প্রচলন রয়েছে। বলিতে ছাগল, মুরগি, কবুতর ও পুরুষ জল মহিষকে বলি দেয়া হয়।
ক্রিস্টোফার ফুলারের মতে, পশু বলির অভ্যাস হিন্দুদের মধ্যে নবরাত্রির সময়, অথবা অন্য সময়ে, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে পাওয়া শাক্তধর্ম ঐতিহ্যের বাইরে, এবং উত্তর-পূর্ব ভারত, আসাম এবং ত্রিপুরা। উপরন্তু, এমনকি এই রাজ্যগুলিতে, উৎসবের মরসুম এমন একটি যেখানে উল্লেখযোগ্য পশু বলি পালন করা হয়।
রাজস্থানের রাজপুতরা নবরাত্রিতে তাদের অস্ত্র ও ঘোড়ার পূজা করে এবং পূর্বে কুলদেবী হিসেবে পূজিত একজন দেবীকে ছাগলের বলি দেওয়া হত। এই রীতি কিছু জায়গায় অব্যাহত রয়েছে এখনও।
একদিনে ৫ লাখ পশু বলী দেয়া হত নেপালের গঢ়িমাঈ মন্দিরে। ৫ বছর পর পর এই নৃশংস ঘটনা ঘটতো। তবে এখন বন্ধ হয়েছে। এই পশুবলী নিষিদ্ধ করার আগে অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার নেটওয়ার্ক নেপাল এবং হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া নামে দুটি পশু অধিকার সংগঠন ধর্মীয় এই প্রথার বিরুদ্ধে সরব হয়।
নেপালের মন্দিরে ৫ বছর পর পর ঘটা পশুবলীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন চলছিলো এবং কোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছিলো মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এদিকে মুসলমানদের কুরবানি প্রতি বছর ঘটে এবং শুধুমাত্র বাংলাদেশে প্রতি বছর কুরবানির সংখ্যা ১ কোটির উপরে! প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ বছর ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১ কোটি ১০ লাখ কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণের জন্য সারাদেশে প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ৫৬৩টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে।
যদি মুসলিম প্রধান বাংলাদেশেই এই পরিমাণ পশুহত্যা ঘটে থাকে তাহলে সারা বিশ্বের কুরবানিতে পশুহত্যা সংখ্যাটা কি পরিমাণ আন্দাজ করা যায়। কিন্তু এত বিপুল বিভৎস পশুবধের মুসলিম এই প্রথার বিরুদ্ধে কি মানবিক সংগঠনগুলো কখনো সরব হয়েছে?
উন্নত বিশ্বের নিষ্ঠুরতা
একভাবে বললে প্রগতির দাম দিচ্ছে জীবজন্তু। ইউরোপ কিংবা জার্মানিকে সমৃদ্ধি ও প্রগতির পরাকাষ্ঠা ভাবলে ভুল করা হবে।
জার্মানিকে বলা হয় ইউরোপের কসাইখানা৷ ইউরোপে সবচেয়ে বেশি শূকর নিধন করা হয় এই জার্মানিতে, বছরে ৫ কোটি ৮০ লক্ষ শূকর৷ গরু মারার ক্ষেত্রে ইউরোপে জার্মানির স্থান ফ্রান্সের পরেই দ্বিতীয়৷ ইউরোপের বৃহত্তম মুরগি মারার খামার হলো জার্মানির নিম্ন স্যাক্সনি রাজ্যের ভিৎসেতে, যেখানে একটি যন্ত্র মিনিটে ৪৫০টি মুরগি মারার ক্ষমতা রাখে৷
প্রথমত প্রাণীদের রাখা হয় খুবই কম জায়গায়৷ মুরগির খামারগুলোর ৭০ ভাগ পঞ্চাশ হাজারের বেশি মুরগি পোষে। যদিও তাদের রাখার নিয়ম হলো প্রতি বর্গমিটারে ৩৩ কিলোগ্রাম মুরগি, অর্থাৎ ২০টি মুরগি৷ তবে এনিয়ম মানা হয় না।
দ্বিতীয়ত তাড়াতাড়ি ওজন বাড়ানো হয়। খামারে পোষা শূকরেদের ওজন বাড়ে ছ’মাসে ১০০ কিলোগ্রাম৷ টার্কি পোষার খাঁচায় দিনরাত আলো জ্বলে, যাতে পাখিগুলো দিনরাত খাবার খেয়ে আরো তাড়াতাড়ি মোটা হয়৷গরুরা অস্বাভাবিক পরিমাণ দুধ দেয়, বছরে ৮,২০০ লিটার৷
যেভাবে প্রাণীদের রাখা হয়, তাতে যে তাদের মধ্যে আগ্রাসন বাড়বে, সেটা স্বাভাবিক৷ তার কুফল এড়াতে বাচ্চা শূকরদের লেজ কেটে দেওয়া হয়, হাঁস-মুরগির ঠোঁট ছোট করে দেওয়া হয়, গরুবাছুরের শিং কেটে ফেলা হয়৷
এর পরে আছে পশুর খাদ্যের নামে নানা ধরনের হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিকের ককটেল৷ সে পর্ব শেষ হলো, তো আসছে বাস্তবিক নিধনের কাজটি, যা যত তাড়াতাড়ি ও কম পরিশ্রমে সম্ভব সম্পন্ন হওয়া চাই৷
তার আগেও থাকতে পারে অ্যানিমাল ট্রান্সপোর্ট নামের এক বিভীষিকা। ট্রাকে করে জীবিত পশুপাখি ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাঠানো, যা কিনা বাণিজ্যিক ইমপ্যারেটিভের অধীন৷
এই ঠান্ডা মহাদেশ এবং জার্মানি নামের ঠান্ডা দেশটিতে ৮০ ভাগ মানুষের প্রিয় খাদ্য এখনও মাংস৷ সব দেখে ও শুনে মনে হবে, ইউরোপে মনুষ্যজীবন যত সমৃদ্ধ, সহজসাধ্য ও আরামদায়ক হয়ে উঠছে, ততই জীবজন্তুদের কপালে জুটছে আরো কম পরিসরে আরো কম সময় বেঁচে থেকে আরো বেশি ডিম-মাংস-দুধ দেবার ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য৷
গবেষণাগারে প্রাণী হত্যা
যে কোনও ওষুধ, ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে মানুষের দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে প্রাণীদের শরীরে পরীক্ষা হয়। যা নিয়ে বিশ্বে এত হইচই, সেই কোভিড টিকার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এটি বিশ্বের সব দেশে প্রযোজ্য। আর এর জন্য মারা যাচ্ছে অগণিত প্রাণী।
শুধুমাত্র সুইৎজারল্যান্ডে ২০২০ সালে গবেষণাগারে পরীক্ষার জন্য ৫ লক্ষের বেশি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের দাবি, প্রাণীদের এ ভাবে ব্যবহার করা অনৈতিক ও অপ্রয়োজনীয়।
প্রাণীদের উপরে গবেষণাগারে পরীক্ষা বন্ধ করা উচিত কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে ভোট করছে সুইৎজারল্যান্ড। প্রাণী-হত্যার বিরোধীরা যদি ভোটে জিতে যান, সে ক্ষেত্রে সুইৎজারল্যান্ডই প্রথম দেশ হবে, যেখানে ল্যাবে প্রাণীর ব্যবহার নিষিদ্ধ হবে।
বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক ও বিক্ষোভ চলছে দেশটিতে। বিক্ষোভকারীদের দাবি, ইঁদুর, গিনিপিগ বা অন্য প্রাণীদের উপরে ল্যাবে পরীক্ষা করা বন্ধ হোক।
তাদের দাবির সমর্থনে সই সংগ্রহ শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। এবং পরিস্থিতি যে দিকে গড়ায় তাতে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। সুইৎজারল্যান্ডের গণতন্ত্রে সকলেরই অধিকার আছে। ভোটে বিক্ষোভকারীদের বিপক্ষে রয়েছে দেশের নামজাদা ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি। রোশে, নোভারটিসের মতো আন্তর্জাতিক ওষুধপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির বক্তব্য, নতুন ওষুধ তৈরিতে এই গবেষণা আবশ্যিক।
তবে ভোটের আগে একটি প্রাক-নির্বাচনী জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ৬৮% মানুষ গবেষণাগারে পরীক্ষার জন্য প্রাণীদের ব্যবহার করার উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, ভোটে হয়তো জিতবে ওষুধ-সংস্থাগুলিই।
এদিকে, ইউরোপে গবেষণামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রতিবছর লাখ লাখ প্রাণী জন্ম দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলো ব্যবহার না করেই আবার হত্যাও করা হয়। সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
জার্মানির কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ৩৯ লাখ প্রাণী ২০১৭ সালে হত্যা করা হয়েছে। পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি এক কোটি ২৬ লাখ। এ ছাড়া গবেষণাগারে হত্যা করা হয়েছিল ২৮ লাখ প্রাণী।
২০১৭ সালে জার্মানিতে গবেষণার কাজে সবচেয়ে বেশি প্রাণী উৎপাদন করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেগুলোর অধিকাংশই ছিল ছোট ইঁদুর।
এ ছাড়া ২ লাখ ৫৫ হাজার বড় ইঁদুর, ১ লাখ ৪০ হাজার মাছ, ৩ হাজার ৫০০ বানর, ৩ হাজার ৩০০ কুকুর এবং ৭১৮টি বিড়ালও ছিল। এসব প্রাণীর ৫০ শতাংশ বিভিন্ন গবেষণামূলক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী হত্যা
করোনা মহামারির সময় লকডাউনসহ নানা কারণে প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমছে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশের জীববৈচিত্র্যে নতুন প্রাণ ফিরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্রও দেখা যাচ্ছে। করোনার এ সময়ে দেশে বন্য প্রাণী হত্যা তুলনামূলক বেড়েছে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি। ২০২১ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় প্রাণী বাঘ হত্যা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরের মধ্যে বেঙ্গল টাইগার মারা গেছে দুটি। এর বাইরে দুটি বাঘ ফাঁদে আটকা পড়ে আহত অবস্থায় মারা যায়। আর গত বছরের জানুয়ারিতে বাগেরহাটে একটি বাঘের চামড়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ একজন পাচারকারীকে আটক করে বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাবউদ্দিন বলেছেন, গত ২৪ বছরে মোট ২৪টি বাঘকে গুলি করে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর ১০টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে একটি করে বাঘ হত্যার শিকার হচ্ছে।
বন্য প্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) বাংলাদেশের হিসাব বলছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে গত বছরের মে পর্যন্ত দেশে ২০টি ডলফিন মারা গেছে। অথচ ২০১৯ সালে ১০টি, ২০১৮ সালে ১৪টি ও ২০১৭ সালে চারটি ডলফিন মারা গেছে। এ হিসাব অবশ্য যেসব ডলফিনের মৃতদেহ সাগরের সৈকতে ও নদীর তীরে ভেসে এসেছে, তার সংখ্যার ভিত্তিতে দাঁড় করানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, দেশের উপকূলে করোনার আগের ১৪ বছরে ১০টি তিমির মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে। সেখানে ২০২০-২১ সালে উপকূলে ভেসে এসেছে চারটি তিমির মৃতদেহ।
এসডব্লিউ/এসএস/২১২০
আপনার মতামত জানানঃ