ভারতের মেঘালয়ের ওয়েস্ট গারো হিলের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল। যেখানে থাকেন সংসারে-রারা আদিবাসী জাতি। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে বাস এই ‘হেড হান্টার’-দের। হ্যাঁ, এই আদিবাসী জাতি একটা সময় রীতিমতো মাথা শিকার করতেন তাদের পুজোর জন্য। মাথা বলতে, মানুষের মাথা।
অথচ উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রেক্ষাপটে নাগারাই প্রথম বিদ্রোহ করে। তারা ভারতীয় রাষ্ট্রে অঙ্গীভূত হতে অস্বীকার করে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
এরই আগে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল (এনএনসি) গঠিত হয়। এ সংগঠনটি নাগা জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধিরূপে নাগা হিলে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য ভারতের কাছে দাবি জানায়।
একসময় ‘হেড-হান্টিং’ বা মাথা শিকার নাগা সমাজব্যবস্থায় এবং নাগা জনজীবনে একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিছক খেলাচ্ছলেও মাথা শিকারে এরা দ্বিধা বোধ করত না।
হয়তো দুই গ্রামের মধ্যবর্তী জঙ্গলের মধ্যে কোনো একটি জলাশয়ে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কেউ মাছ ধরতে এসেছে অপর গ্রামের কেউ পেছন থেকে আক্রমণ করে তার মাথাটাই কেটে নিয়ে দৌড়ে চলে আসত। হতভাগ্য মৎস্য শিকারীর দেহ পড়ে থাকত জলাশয়ের ধারে আর কর্তিত মস্তক চলে যেত হত্যাকারী নাগা যুবকের ঘরে শোভাবর্ধক ও বীরত্বব্যঞ্জক হিসেবে।
আসলে এখানকার প্রতিটি গ্রাম হয়ে উঠেছিল এক একটি অভেদ্য দুর্গ। কারণ এই আদিবাসীরা তাদের বসতি গড়েছিল খাড়া পর্বতশৃঙ্গে, সেই সঙ্গে এই বসতিগুলির চারপাশে প্রাচীর তোলা হয় বড় বড় উঁচু উঁচু পাথর সাজিয়ে, এবং সব মানুষের যাতায়াতের জন্য বানানো হয়েছিল একটিই মাত্র দরজা।
নাগাদের অতীত নিয়ে কথা বললেই চলে আসে মাথা কাটার কথা। নাগাদের এক উপজাতিদের বলা হয় সাংসারেক। ছোট ছোট কুঁড়েঘরে বাস করেন সংসারেকরা। এখন অবশ্য শিক্ষার আলো একটু একটু করে পৌঁছোচ্ছে এখানে। পৌঁছোচ্ছে মোবাইল, সভ্যতার নানা উপকরণ।
কিন্তু এদেরই একটা সময় রীতিমত ভয় পেত লোকে। কারণ, এদের শিকারের মনোভাব। এই মাথা শিকার এদের শক্তি প্রদর্শনের, ক্ষমতা প্রদর্শনের একটা অঙ্গ ছিল বলা চলে।
যার বাড়িতে য’টা মাথা, মানে নরমুণ্ড থাকবে, তাঁর প্রতিপত্তি তত বেশি। প্রথাগত পুজোর সঙ্গেও এর যোগ রয়েছে। এই পুজোর একটি অন্যতম আচার হল ‘ত্যাগ’। অর্থাৎ, দেবতার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদান। একটা সময় এই অনুষ্ঠানেই নরবলি করা হত। তারপর সেই মাথা এনে, ‘ট্রফির’ মতো সাজিয়ে রাখা থাকত ছোট ঘরগুলিতে।
সাধারণ নাগারা এখনও নিজেদের চিরাচরিত সমাজের শিকড় ছেড়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। তারা সহজে নাগাল্যান্ডের বাইরে যেতে চায় না। এমনকী বাইরের মানুষকেও তারা সহজে গ্রহণ করতে পারে না।
২০০ বছর আগের সেই নরবলির প্রথা এখন আর নেই যদিও। নেই সেই নরমুণ্ডও। সংখ্যায়ও ধীরে ধীরে কমে আসছে সংসারেকরা। তাদের আচার, তাদের পুজো, তাদের উৎসব— সমস্ত কিছুই এখন বিপন্নতার মুখে।
এই আদিবাসী জাতির মধ্যে যারা পড়াশোনা ও জীবিকার জন্য অন্যত্র থাকেন, তারা এখন প্রবল চেষ্টায় রয়েছেন এই সংস্কৃতিকে উদ্ধার করার। যারা আছেন, তাদের মধ্যে দিয়েই বাঁচিয়ে রাখার একটা চেষ্টা করছেন তাঁরা। শিক্ষা, আধুনিকতার সঙ্গে যাতে পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে না যায়, সেই চেষ্টাই জারি রয়েছে নাগাদের মধ্যে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ