ব্রেইন সারা শরীরে নেটওয়ার্ক বা জাল বিছায় স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে। এ নেটওয়ার্কই হলো স্নায়ুতন্ত্র। ধরা, ছোঁয়া, ব্যথা, বেদনা, কোনো অঙ্গ কি কাজ করবে, এসব কিছুর অনুভূতি স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে ব্রেইনে পৌঁছে। স্পাইনাল কর্ড থেকে একগুচ্ছ স্নায়ু শরীরের ডান অংশে যেমন জাল বিছিয়ে আছে, ঠিক আরেকগুচ্ছ স্নায়ু শরীরের বাঁ অংশে জাল বিছিয়ে আছে। এ জাল বিছানো স্নায়ুতন্ত্রের কোনো অংশ যদি কোনোভাবে বিকল বা দুর্বল হয়ে পড়ে, তা হলে সেই অংশে অসাড় ভাব দেখা দেয়।
এ অসাড় ভাবের নামই প্যারালাইসিস। যে কোনো কারণে যদি পেশি ড্যামেজ বা স্পাইনাল কর্ড ড্যামেজ কিংবা মস্তিষ্কের থ্যালেমেসিয়া অঞ্চলের যে কোনো অংশ ড্যামেজ হয়ে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হ্রাস পায় বা স্নায়ুতন্ত্রের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয় অথবা ছিঁড়ে প্যারালাইসিস বা পক্ষাঘাতের সূচনা হতে পারে।
স্পাইনাল কর্ডের জটিলতার কারণে হাঁটাচলা করতে পারে না, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এমন অসুস্থ রোগীদের জন্য সুসংবাদ দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
তারা বলছেন, তারা স্পাইন কর্ড তৈরি করতে যাচ্ছেন। এ দিয়ে আজীবনের জন্য হুইলচেয়ারে বসে পড়া মানুষেরা আবারও হাঁটাচলা করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, স্পাইনাল কর্ডের মূল উপাদান স্নায়ুকোষ। এটির কাজ হলো মস্তিষ্ক থেকে কোনো নির্দেশ শরীরের নির্দিষ্ট অংশে পৌঁছে দেওয়া। স্পাইনাল কর্ড আর মস্তিষ্ক মিলে মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র (সিএনএস) গঠিত হয়। স্পাইনাল কর্ডের কোনো সমস্যা হলে মাসকুলার ডিসট্রোপি নামক রোগ হয়। এ ধরনের অসুখে আক্রান্ত হলে মানুষের মেরুদণ্ড, মাংসপেশি ও কঙ্কাল দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে স্বাভাবিক চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটে এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও তৈরি হয়।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট–এর খবরে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য ত্রিমাত্রিক এই ইমপ্ল্যান্টে মানুষের কোষ ব্যবহার করা হয়েছে। এ চিকিৎসাপদ্ধতি ইতিমধ্যে ইঁদুরের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে ৮০ শতাংশ সফলতা এসেছে।
সর্বশেষ এ গবেষণা চালিয়েছেন ইসরায়েলের তেল আবিব ইউনিভার্সিটির বায়োমেডিকেল প্রকৌশল বিভাগের একদল গবেষক। এর আগে এমন গবেষণা চালিয়েছিলেন জার্মানির গবেষকেরা।
জার্মানির ওই গবেষকেরা অবশ্য স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা নিয়ে কাজ করছিলেন। গত জানুয়ারিতে বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছিল, জার্মানির গবেষকেরা ইঁদুরকে হাঁটাতে সক্ষম হয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে একধরনের প্রোটিন প্রবেশ করানো হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ওই ইঁদুরের স্নায়ুতন্ত্র সচল করা হয়েছিল। এ কারণে ইঁদুর হাঁটতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে ইসরায়েলের বিজ্ঞানীরা যে গবেষণা চালিয়েছেন, তা ভিন্ন। ইসরায়েলের গবেষক দলের প্রধান তাল দিভির বলেন, যে ব্যক্তির স্পাইনাল কর্ড তৈরি করা হবে, তার পেটের চর্বি থেকে কোষ নেওয়া হবে। জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে এই কোষ পরিবর্তন করা হবে।
এ পদ্ধতিতে পেটের ওই কোষকে শরীরের যেকোনো ধরনের কোষে পরিবর্তিত করা সম্ভব হবে। এই বিজ্ঞানী বলেন, পরিবর্তিত এই কোষ থেকে স্পাইনাল কর্ড তৈরি করা হবে।
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী অ্যাডভান্স সায়েন্স–এ এই গবেষণা প্রকাশ করা হয়েছে। ইসরায়েলের এ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইতিমধ্যে ইঁদুরের স্পাইনাল কর্ড তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
কয়েক বছরের মধ্যে তারা এর চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষা মানুষের ওপর চালাবেন। আর এ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
তাল দিভির বলেন, বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ রয়েছে, যারা স্পাইনাল ইঞ্জুরির কারণে চলাফেরা করতে পারে না। এখনো এর কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো, প্যারালাইজড প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আলাদা স্পাইনাল কর্ড তৈরি করা।’
স্পাইনাল ইনজুরি
স্পাইনাল ইনজুরিকে বাংলায় বলে মেরুদণ্ডে আঘাত। এর মধ্যে রয়েছে কশেরুকা ভেঙে যাওয়া ও স্থানচ্যুত হওয়া। চুলন এ বিষয়ে সবিস্তারে জেনে নেয়া যাক।
মেরুদণ্ডে কী থাকে?
– স্পাইনাল কর্ড
– হাড় যা স্পাইনাল কর্ডকে সুরক্ষা দেয় (একে বলে ভার্টিব্রা বা কশেরুকা)
– দুই কশেরুকার মাঝখানে চাকতিসদৃশ ডিস্ক
– ঘিরে থাকা মাংসপেশি
– স্পাইনাল কর্ড থেকে বেরিয়ে আসা নার্ভ বা স্নায়ু
যদি কারো স্পাইনাল ইনজুরি হয় তাহলে সবচেয়ে বড় যে ঝুঁকি থাকে তা হলো তার স্পাইনাল কর্ড অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদি সে রকম কিছু ঘটে তাহলে আঘাতের স্থানের নিচ থেকে রোগীর শরীর প্যারালাইসড বা অসাড় হয়ে যায়।
আঘাতের কারণ?
দুই ধরনের আঘাতে স্পাইনাল ইনজুরি হয়।
– পরোক্ষ আঘাত
– প্রত্যক্ষ বা সরাসরি আঘাত
যে কারণে পরোক্ষ আঘাত ঘটে
– ভারী কিছু তুললে
– হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গেলে
প্রত্যক্ষ আঘাতের কারণ
– উঁচু থেকে পড়ার সময় পিঠ মাটিতে পড়লে
– পিঠের ওপর ভারী কিছু পড়লে।
স্পাইনাল ইনজুরির সবচেয়ে সাধারণ কারণের মধ্যে রয়েছে প্রবল ধাক্কা, তীব্র মোচড়ানো, কিংবা সামনে বা পেছনের দিকে বেঁকে যাওয়া।
যদি কেউ নিচের দুর্ঘটনায় পড়েন তাহলে স্পাইনাল ইনজুরির আশঙ্কার কথা মাথায় রাখবেন
– উঁচু স্থান থেকে পড়ে যাওয়া। যেমন : মই।
– বেঢপভাবে পড়ে যাওয়া, যেমন শরীরচর্চা করতে গিয়ে
– অগভীর পুলে ডাইভ দেয়া ও আঘাত পাওয়া
– চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, যেমন মোটরবাইক
– ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া
– মোটরগাড়ি দুর্ঘটনা
– পিঠে ভারী কিছু পড়া
– মাথায় বা মুখে আঘাত পাওয়া
স্পাইনাল ইনজুরি কিভাবে বুঝবেন?
যদি কশেরুকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়
– ঘাড়ে বা পিঠে ব্যথা করা।
– মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক আকৃতিতে পরিবর্তন ঘটা। সেটি অস্বাভাবিক আকৃতির হতে পারে কিংবা প্যাঁচানো হতে পারে।
– মেরুদণ্ডের ওপরের ত্বকে ব্যথা অনুভূত হওয়া বা ত্বকে কালশিরা পড়া।
যদি স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়
– হাত-পায়ের নাড়াচাড়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো। অর্থাৎ, হাত বা পা নাড়াতে বললে সেগুলো নাড়াতে না পারা।
– অনুভূতিশূন্য হওয়া, কিংবা অস্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া। যেমন, জ্বালাপোড়া করা বা মিনমিন করা।
– প্রস্রাব বা পায়খানার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।
– শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হওয়া।
কী করবেন?
– রোগীকে আশ্বস্ত করুন, নড়াচড়া করতে নিষেধ করুন।
– অ্যাম্বুলেন্স ডাকার ব্যবস্থা করুন।
– রোগীকে মাথা বা ঘাড় নাড়াতে নিষেধ করুন যাতে পুনরায় ক্ষতি না হতে পারে।
– রোগীর মাথার পেছনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ঝুঁকে বসুন। আপনার কনুই দুটো মাটিতে রাখুন। রোগীর মাথার দুই পাশে হাত নিয়ে ধরুন, কান দুটো খোলা রাখুন। রোগীর মাথা এমনভাবে ধরুন যাতে তার মাথা, ঘাড় ও মেরুদণ্ড সোজাসুজি লাইনে থাকে।
– জরুরি সাহায্য না আসা পর্যন্ত আপনি রোগীর মাথাকে সাপোর্ট দিয়ে রাখুন। যদি আপনার ধারেকাছে কেউ থাকে তাহলে তাকে বলুন রোগীর মাথার দুই পাশে কম্বল, তোয়ালে কিংবা কাপড় ভাঁজ করে সাপোর্ট দিতে।
যদি রোগী সাড়া না দেয়
– রোগীর শ্বাসপথ খোলা রাখুন। এ ক্ষেত্রে রোগীর মুখে আঙুলের ডগা ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে হাঁ করান। খেয়াল রাখবেন ঘাড় যেন বেঁকে না যায়।
– এবার শ্বাস নিচ্ছে কি না পরীক্ষা করুন।
– যদি শ্বাস নেয় তাহলে রোগীর মাথাকে অবিরাম সাপোর্ট দিয়ে যান এবং অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন।
– রোগী যদি শ্বাস না নেয় তাহলে রোগীকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে শুরু করুন।
– অ্যাম্বুলেন্স না আসা পর্যন্ত রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস হৃদস্পন্দন ও প্রতিক্রিয়ার মাত্রা পরীক্ষা করতে থাকুন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ