সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন। বিষয়টি এখন শুধু আলোচনার টেবিলেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন ছাড়িয়ে পড়েছে মাঠ-পর্যায়ে আন্দোলনের মতো।
বর্তমান সময়ে মনুষ্যজনিত গ্রিনহাউজ গ্যাসের ফলে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ ধরা হয়। যেটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিরতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। আর জলবায়ুর এহেন পরিবর্তনের মারাত্মক ঝুঁকিতে আফ্রিকার হতদরিদ্র মানুষ।
আফ্রিকার দেশ কেনিয়া, সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার কিছু এলাকার ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ খরার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এসব তথ্য জানায়।
ডব্লিউএফপি জানায়, ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ হিসেবে পরিচিত এ অঞ্চলে পরপর তিনটি বর্ষা মৌসুম অনাবৃষ্টিতে গেছে। এর ফলে এখানে ১৯৮১ সালের পর থেকে সবচেয়ে শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করছে।
চরম এই খরার ফলে ফসল বিনাশ ও ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বহু গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে পশুপালন ও কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল গ্রামীণ পরিবারগুলো তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
হর্ন অব আফ্রিকার বাসিন্দা মোহামেদ আদেম রয়টার্সকে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা আগে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। বৃষ্টির কোনো আভাস নেই, কেবল ধুলো ঝড় হয় এই অঞ্চলে। আমাদের ভয় হচ্ছে— দ্রুতই হয়ত এই পুরো এলাকা একটি সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হবে।’
জিবুতি, ইথিওপিয়া, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া ও সোমালিল্যান্ড- এই ৫ দেশের ভূখণ্ডের কিছু কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হর্ন অব আফ্রিকা নামের এই ভৌগলিক অঞ্চলটি। ইথিওপিয়া সরকারের মুখপাত্র লেগেসে তুলু, ‘যদিও এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি, কিন্তু দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে এখানকার খরা পরিস্থিতি। ডব্লিউএফপি যে সতর্কবার্তা দিয়েছে, তাতে কোনো ভুল নেই।’
ডব্লিউএফপির পূর্ব আফ্রিকার আঞ্চলিক পরিচালক মাইকেল ডানফোর্ড বলেছেন, এমনিতেই পানির সরবরাহ ও চারণভূমির সংকট চলছে। তার মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সামনের মাসগুলোতে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম দেখাচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
‘আমরা আগে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। বৃষ্টির কোনো আভাস নেই, কেবল ধুলো ঝড় হয় এই অঞ্চলে। আমাদের ভয় হচ্ছে— দ্রুতই হয়ত এই পুরো এলাকা একটি সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হবে।’
এক বিবৃতিতে ডানফোর্ড বলেন, ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, গবাদিপশু মারা যাচ্ছে। পরপর তিন মৌসুমের খরায় ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলে খাদ্যসংকট বেড়েই চলছে। সোমালিয়ার মতো বড় ধরনের অঘটনের পুনরাবৃত্তি এড়াতে এখনই মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
এই অঞ্চলের অপর দেশ সোমালিয়ায় অবশ্য ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তীব্র খরা দেখা দিয়েছিল। সেসময় দেশটিতে না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। তাদের অর্ধেকই ছিল শিশু।
বর্তমানেও সেই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন ইউনিসেফ পূর্ব আফ্রিকা শাখার পরিচালক মোহামেদ ফাল। রয়টার্সকে তিনি জানান, বর্তমান খরা পরিস্থিতিতে খাদ্যাভাবে মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে হর্ন অব আফ্রিকার অন্তত ৫৫ লাখ শিশু।
‘যদি আমরা সত্যিই বিপর্যয়কে ঠেকাতে চাই, তাহলে এখন থেকেই আমাদের কাজ শুরু করা উচিত,’— নাইরোবি থেকে রয়টার্সকে বলেন মোহামেদ ফাল।
কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার সংশ্লিষ্ট এলাকায় ইতিমধ্যে খাদ্যসহায়তা শুরু হয়েছে। এসব স্থানে এমনিতেই অপুষ্টির হার বেশি। বলা হচ্ছে, চলমান পরিস্থিতিতে সেখানে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই মারাত্মক ক্ষুধার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এর মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইথিওপিয়ায় প্রায় ৫৭ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন, যার মধ্যে ৫ লাখ অপুষ্টিতে ভোগা মা ও শিশু। মে মাসের মধ্যে জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে সোমালিয়ায় গুরুতরভাবে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৩৫ লাখ থেকে ৪৬ লাখ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর কেনিয়ায় ২৮ লাখ মানুষের খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন। সেখানে খরার কারণে গত সেপ্টেম্বরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। ডব্লিউএফপি বলেছে, এ অঞ্চলে আগামী ছয় মাস ত্রাণ ও অন্যান্য তৎপরতা চালাতে ৩২ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলারের প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা সময়ের একটি সংজ্ঞায়িত সমস্যা। পৃথিবী হুমকির সম্মুখীন এবং মানুষ অদৃশ্য হওয়ার বিপদে! জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দেশ, ধর্ম এবং মতপার্থক্য যাই হোক না কেন লড়াই করার জন্য সবাই একসঙ্গে থাকা আবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিনিয়তই ঘটছে, এমনকি কপ২৫-এ জলবায়ু আলোচনার জন্য বিশ্ব নেতারা বৈঠক করে জানিয়েছেন, ‘আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা থামানোর জন্য যথেষ্ট কিছু করছি না।’ আসলে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
জাতিসংঘ বলছে, আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই পৃথিবী ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি উষ্ণ হওয়ার পথে। পরিবেশদূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলে বরফ গলে যাচ্ছে। সমুদ্র ও নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। নিম্নভূমি ডুবে যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টি, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। লাখ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বিপর্যয় শুরু হবে ২০৩০ সালে। এটি ২০৫০ সালে ভয়াবহ আকার নেবে। সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চার কোটি মানুষ অভিবাসী হবে। যার অর্ধেক হবে বাংলাদেশি।
আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, বিমান ভ্রমণ পরবর্তী ২০ বছরে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ আরো ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। ফলস্বরূপ, দুর্যোগ আরো দ্রুত তরান্বিত হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী তিন দশকে ২১৭ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হবে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং বিশ্বজুড়ে সম্পদের বৈষম্য কমাতে জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। প্রতিবেদনে সংকট মোকাবিলায় ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন কমাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ, অভিবাসনের হার পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানযোগ্য। আমাদের কাছে প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। প্রয়োজন নেতৃত্ব এবং পথ পরিবর্তন করার সাহস। দূষণ রোধ করার জন্য শক্তির সুব্যবহার জরুরি। আমাদের ২০৫০ সালের মধ্যে বা শিগগিরই ‘নিট জিরো’ কার্বন নির্গমকে নিশ্চিত করতে হবে। নিট জিরো মানে— ক্রমান্বয়ে কার্বনের ভারসাম্যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনা। নিট শূন্য নির্গমন অর্জনের জন্য, আমরা যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি এবং ব্যবহার করি তার ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫২
আপনার মতামত জানানঃ