বর্তমান মানচিত্র যেমন দেখা যাচ্ছে, চিরদিন এরকমই থাকবে, তা ভাববার কোনো অবকাশ নেই। ভবিষ্যতে ভূগর্ভস্থ সমীকরণের কারণে দেখা যেতে পারে নানা রকম পরিবর্তন। পুরনো কোনো মহাদেশ ভেঙ্গে গড়ে উঠতে পারে নতুন ঠিকানা। ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ নিয়ে গড়ে উঠতে পারে নতুন মহাদেশ।
ভারত, মাদাগাস্কার এবং সোমালিয়া; এই তিন দেশ রয়েছে সেই একই মহাদেশের মধ্যে। শুনতে হয়তো অবাক লাগছে। কারণ ভারত রয়েছে এশিয়ার দক্ষিণে। আর সোমালিয়া রয়েছে সেই পূর্ব আফ্রিকায়। তারও দক্ষিণে মাদাগাস্কার দ্বীপ। আর মাঝে বয়ে গিয়েছে ভারত মহাসাগর।
কিন্তু না, কোনো আজগুবি কথা নয়। বরং সত্যিই এই তিন দেশ একসঙ্গে জুড়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি বছর পরের সেই মানচিত্র তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা।
আর তাতেই দেখা গিয়েছে, ভারতের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এমনকি এই জুড়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হতে পারে আরও এক বিরাট পর্বত। হিমালয়ের সঙ্গে নাম মিলিয়ে যার নাম রাখা হয়েছে সোমালয়।
নেদারল্যান্ডসের উৎরেচ ইউনভার্সিটির ভূতত্ত্বের অধ্যাপক দ্যুয়ে ভান হিনসেনবার্গ এবং তার ছাত্রছাত্রীরা মিলে তৈরি করে ফেলেছেন ২০০ মিলিয়ন বছর পরের এই মানচিত্র। প্রায় ২ বছরের চেষ্টায় অবশেষে ভবিষ্যতের রূপ দেখতে পেলেন তারা।
এর আগে পৃথিবীর অতীতের মানচিত্রের নানা মডেল তৈরি করেছেন অধ্যাপক হিনসেনবার্গ। ভূমধ্যসাগরের জায়গায় যে একসময় একটি স্থলভাগ ছিল, তাও প্রমাণ করেছেন তিনি।
কিন্তু ভবিষ্যতের মানচিত্র তৈরি এই প্রথম। অবশ্য এরকম একটা পরিকল্পনা দীর্ঘদিন ধরেই ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি। আর তাই ২০১৯ সাল থেকে শুরু করে দিয়েছিলেন এই গবেষণার কাজ।
গবেষণা দলটি জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সিশেলস ও মরিশাস দ্বীপপুঞ্জে বিরাট ধাক্কা নেমে আসবে। এখন যেমন হিমালয়ের পাদদেশে নতুন দিল্লি রয়েছে, প্রকৃতির সেই পরিবর্তনে মুম্বাই চলে আসবে সোমালয় রেঞ্জের পাদদেশে।
ড. ভ্যান হিন্সবার্গেন এক ব্যাখ্যায় বলেন, হর্ন অব আফ্রিকা, যার মধ্যে রয়েছে সোমালিয়াও, তা দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতকে অতিক্রম করে একটি বিশাল পর্বতমালা তৈরি করবে। কীভাবে টেকটোনিক প্লেটগুলো সরানো হয়েছে, তা কত দ্রুত, কোন পথে গেছে ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে তারা এই ধারণা করছেন।
গবেষণায় ধরে নেয়া হয়েছে, আফ্রিকা মহাদেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া এবং পূর্ব আফ্রিকান হ্রদের নীচে থাকা ফাটল আফ্রিকার দুটি অংশকে বিভক্ত করতে থাকবে। এর ফলে পরবর্তী ২০ কোটি বছরে একটি মহাদেশ তৈরি হবে।
সে সময় ভারত মহাসাগরের অবস্থান সম্পর্কে প্রধান গবেষক হিন্সবার্গেন বলেন, আফ্রিকায় যখন এই মহাদেশ তৈরি হবে, তখন অবশ্যই ভারত মহাসাগর অপসারিত হবে। মূলত মালাবারের সৈকত এবং প্রবাল প্রাচীর, সমুদ্র সৈকত ও নিচু অঞ্চলগুলো ক্রমশ ভাঁজ হয়ে উচ্চ শিখরে পরিণত হবে।
সিশেলসও লাক্ষাদ্বীপের পাশে বসবে এবং মালাবার পর্বত হিমালয়ের মতো আট হাজার মিটার উঁচু একটি পর্বতশ্রেণিতে পরিণত হতে পারে। এর ফলে এভারেস্টের মতো পাহাড়ের চূড়ায় পুরনো প্রবাল প্রাচীর খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
তবে এই মানচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে কিছুটা অনুমানের আশ্রয়ও নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আসলে ভারত মহাসাগরের অবস্থান যে একদিন পুরোপুরি বদলে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।
কিন্তু সেই সময় ভারতের কাছে আন্টার্কটিকার কোনো অংশও এগিয়ে আসতে পারে। এগিয়ে আসতে পারে অস্ট্রেলিয়া। আবার আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলও এগিয়ে আসতে পারে। এক্ষেত্রে শেষ সম্ভাবনাটিই ধরে নেওয়া হয়েছে।
গবেষকদের মতে, আফ্রিকার মাঝামাঝি শিলাস্তরে একটি গভীর ফাটল রয়েছে। এর ফলে ভারত মহাসাগরের অবস্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশ দুভাগ হয়ে যাওয়ারও সমান সম্ভাবনা রয়েছে। তখনই এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
গবেষক দলটি ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, অতীতে দুটি প্রাচীন মহাদেশের যে ফল্ট লাইনগুলির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল তা দুর্বল রয়ে গেছে। সুতরাং, আফ্রিকার মতো মহাদেশগুলো সেই পুরনো ফল্ট লাইনগুলিকে ভেঙে ফেলতে পারে। এভাবেই মূলত ৯ কোটি বছর আগে ভারত মাদাগাস্কার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল।
দেখা গিয়েছে, সেক্ষেত্রে বর্তমান সিচেলিস দেশটি চলে আসবে একেবারে মুম্বাই শহরের কাছে। আর সোমালিয়া থাকবে লাক্ষাদ্বীপের কাছাকাছি। এই এলাকাজুড়ে যে পর্বত তৈরি হবে, তার উচ্চতাও হবে প্রায় ৮ হাজার মিটার। অর্থাৎ হিমালয়ের সমান। আর মুম্বাই শহর থাকবে সেই পর্বতের ঠিক পাদদেশে।
অন্যদিকে মাদাগাস্কার আর মরিশাস দ্বীপ একসঙ্গে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানেও একটি ছোটোখাটো পর্বত গড়ে উঠতে পারে। তবে এই সবকিছু ঘটতেই এখনও ২০০ মিলিয়ন বছর লাগবে। ফলে, এক্ষুনি আশঙ্কিত বা উৎসাহিত না হলেও চলে!
ড. ভ্যান হিন্সবার্গেন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মহাদেশগুলো চিরকালের জন্য বিদ্যমান নয়। এই যেমন গত কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে ভারতের অস্তিত্ব রয়েছে। তার আগে এটি একটি দ্বীপ ছিল।
ভবিষ্যতের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্ভবত পূর্ব ভারতের সঙ্গে জুড়ে যাবে। ভবিষ্যতে ভারত মঙ্গোলিয়ার মতোও হতে পারে। অর্থাৎ উচ্চ পর্বতশ্রেণি দ্বারা বেষ্টিত একটি বিশাল মহাদেশের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত।
গবেষক দলটি প্রত্যাশা করছে, নতুন এ আবিষ্কার জলবায়ু, জীবন ও সম্পদের বিবর্তন বুঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ