১৮৬৬ সালে স্থাপিত এই মাদ্রাসায় আফ্রিকা থেকে চীন, সাইবেরিয়া থেকে তুরস্ক, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া–সব জাতিবর্ণের শিক্ষার্থী এসেছেন যুগ যুগ ধরে। একসাথে বসে আত্মস্থ করেছেন ধর্মশিক্ষা। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয়, পুরো ইসলামী দুনিয়ায় বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ।
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এই মাদ্রাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আর পেছনে রয়েছে কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি।
প্রসঙ্গত, বিশ্বের বহু দেশের মুসলিমরাই তাদের ধর্মীয় পথনির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের দিকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করে থাকে যে তাবলীগ জামাত, তারাও এই দেওবন্দের অনুসারী বলেই পরিচিত।
দেওবন্দ বনাম বিজেপি
সম্প্রতি মাদ্রাসার একেবারে কাছাকাছি পুলিশের সন্ত্রাসবাদবিরোধী স্কোয়াডের (এটিএস) দপ্তর খুলেছে ভারত সরকার। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়, দারুল উলুমের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণও আছে যথেষ্ট। উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। কেন্দ্রীয় শাসনভারও তাদের হাতেই। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হলেন দলের অতি-রক্ষণশীল নেতা বলে পরিচিত যোগী আদিত্যনাথ। তার হাতেই দলের নেতৃত্বের ঝাণ্ডা ওঠার গুঞ্জন রয়েছে খোদ বিজেপির তরফেই।
গেল জানুয়ারিতে আদিত্যনাথ স্বয়ং দেওবন্দে এটিএসের দপ্তর উদ্বোধন করেন। এই শহরে মুসলমানরা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। আদিত্যনাথ এই স্থাপনাকে বলেছেন ‘সন্ত্রাসীদের প্রতি বার্তা’- এর মাধ্যমে তিনি দেওবন্দের সাথে দায়েশ বা আইএসআইএস সন্ত্রাসীদের এক করে দেখিয়েছেন। যেন দেওবন্দীরাই ছড়িয়ে দিচ্ছেন দায়েশের মতো উগ্র-মতাদর্শ।
মাদ্রাসার কাছাকাছি একটি সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট স্থাপন শহরের অধিকাংশ বাসিন্দাদের জন্য একটি অপ্রীতিকর বিস্ময় হিসাবে এসেছিল। স্থানীয়রা জানান, এটিএস দপ্তরের প্রায় ১০০ জন বিশেষ বাহিনীর সদস্য এই ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের নয়া প্রতিবেশী হবে।
দেওবন্দে পড়তে আসেন ভারতের নিম্ন-আয়ের মুসলমান পরিবারের সন্তানেরা। মাদ্রাসায় এসব পরিবার যুগ যুগ ধরে অনুদান দিয়ে আসছে। মাদ্রাসার এত কাছে একটি সামরিক বাহিনীর মতো স্থাপনা তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তারা সন্তানদের দেওবন্দে পাঠাতেও ভয় পাচ্ছেন।
তেমনই একজন অভিভাবক হলেন কলকাতার একটি হাসপাতালের কর্মী লতিফা আহমেদ। তার ভাগ্নে দারুল উলুমে আরবি ও ধর্মশিক্ষা বিষয়ে পড়ছেন।
লতিফা বলেন, “উত্তর প্রদেশে মুসলমানদের ওপর হামলা-নির্যাতনের অনেক ঘটনা শুনেছি। আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। ওর বাবা নেই। পড়াশোনা শেষে ফিরে এসে সে পরিবারের হাল ধরবে এটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু, এখন ওর মা কোনো কথা শুনতে চাইছেন না; তিনি আগেই ওকে ফিরে আসার তাগাদা দিচ্ছেন।”
এর আগে গেল জানুয়ারিতে হয় আরেক ঘটনা। এসময় ভারতের জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন (এনসিপিসিআর)- শিশু অধিকার ‘লঙ্ঘন’ হয়েছে এমন ফতোয়া জারির অভিযোগ তোলে দেওবন্দের ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধে। বিষয়টি তারা উত্তর প্রদেশ সরকারকে তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছে।
এনসিপিসিআর চেয়ারপার্সন প্রিয়াঙ্ক কানোনগো ওই ফতোয়ার ব্যাপারে বলেন, “মাকে প্রাপ্তবয়স্ক দত্তক সন্তানের সামনে পর্দা করার কথা বলে সেখানে ভারতের জাতীয় আইনকে ভঙ্গ করা হয়েছে।”
আশরাফ উসমানী জানান, এখনও তারা ওয়েবসাইট বন্ধের ব্যাপারে সরকারি কোনো নির্দেশনা পাননি।
যেকারণে বিজেপির লক্ষ্যবস্তু দেওবন্দ
উত্তর প্রদেশ হল ভারতের বৃহত্তম রাজ্য। জনসংখ্যা অনুসারে স্থানীয় বিধানসভায় রয়েছে ৪০৩টি আসন আর ভারতের ৫৪৩ সদস্যের জাতীয় সংসদে রাজ্যটির প্রতিনিধিত্ব ১৫ শতাংশ। এই রাজ্য দেশটির প্রায় ১৭ শতাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করে। এ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের ভাগ্যনির্ধারণ করবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে গভীর মেরুকরণ প্রায় সবসময়ই উত্তরপ্রদেশ বা ইউপিতে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে লাভবান করেছে। পশ্চিম ইউপিবাসী জনসংখ্যার ২৫ শতাংশই হলেন মুসলমান, তাদের ৪০ শতাংশ থাকেন আবার এক ডজনের মতো জেলাতে।
সংখ্যালঘুদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তাদের উস্কে দেওয়া পুরোনো কৌশল। তারা প্রত্যাঘাত করলে হিন্দু ভোটাররা বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
উত্তর-পশ্চিম ইউপির একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ২০১৭ সালের নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের বিজেপিমুখী করে। নির্বাচনে রাজ্যের বিধানসভায় ৭৫ শতাংশের বেশি আসন পায় দলটি।
অনেকেই মনে করেন সরকারের এটিএস দপ্তর স্থাপন বা দারুল উলুম ওয়েবসাইট বন্ধের চেষ্টা আসলে সংখ্যালঘুদের উস্কানি দেওয়ার শামিল, একবার তা করা গেলেই হিন্দু ভোটব্যাংকের সমর্থন নিশ্চিত হবে।
এনসিপিসিআর চেয়ারপার্সন প্রিয়াঙ্ক কানোনগো অবশ্য দারুল উলুমকে তদন্তের নির্দেশদানের সাথে ইউপি নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক থাকার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।
দেওবন্দ কতটা অরাজনৈতিক
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেওবন্দের আলেমদের ভূমিকা নিয়ে লেখা বেশকিছু বইয়ের লেখক এবং দেওবন্দ পর্যবেক্ষক সৈয়দ উবাইদুর রহমান বলেন, দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাকারীরা ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিলেন। তারা ভারত-ভাগের বিরোধিতা করেছেন, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিলেন।
এর আগে তারা ফতোয়া দিয়ে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়েছেন। ভারতীয় জাতীয়তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন বরাবরই। তারপরও সেই মাদ্রাসার কাছেই এটিএসের দপ্তর খোলা হলো।
এদিকে, দেওবন্দে কোনোপ্রকার উগ্রমত চর্চা নেই বলে জানান ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক, অপেরা লেখক জন বাট। তিনি নিজে পাঁচ বছর দেওবন্দে ইসলামিক থিওলজির ছাত্র ছিলেন। পড়েছেন ইসলামি বিচার ব্যবস্থা, আরবি ব্যাকরণ, সাহিত্য, কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা।
জন জানান, মাদ্রাসায় পড়ার সময় কোনো শিক্ষককে তিনি ছাত্রদের উগ্র মতাদর্শে দীক্ষিত করার চেষ্টা করতে দেখেননি। তার মতে, আমার শিক্ষাগ্রহণের সময় দেখেছি, দারুল উলুমের সম্পূর্ণ ধ্যানজ্ঞ্যান কেবল একাডেমিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পারদর্শীতা অর্জনে নিয়োজিত।
দারুল উলুমে কাশ্মীর থেকে আসা আরও দুই শিক্ষার্থীর সাথে আমার পরিচয় হয়। আমাদের মধ্যে কোনোদিন উগ্রবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে আলোচনাও হয়নি। আমাদের কথাবার্তা হতো একাডেমিক শিক্ষা আর আধ্যাত্মিক বিষয়ে। এমনই সেখানকার আবহ।
কাশ্মীর উপমহাদেশের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল, যার দখল নিয়ে ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগের পর থেকে তিন তিনটি যুদ্ধ লড়েছে ভারত ও পাকিস্তান। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে প্রশাসনিকভাবে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ জনগণের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা রয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে হোক বা অর্থনৈতিক কারণে দারুল উলুম কখনোই ভারত রাষ্ট্রের ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। আর্থিকভাবে শিক্ষাকেন্দ্রটি সব সময় ব্যক্তিগত অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। বেশিরভাগ অনুদান আসতো বার্ষিক প্রতিশ্রুতি থেকে। আয়ের জন্য কোনো ওয়াকফ সম্পত্তি বা অভিজাত সম্প্রদায়ের একক ব্যক্তি-নির্ভরশীলতা ছিল না।
উত্তরপ্রদেশ বিজেপির অভিযোগ, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের সাথে আর্থিক যোগাযোগ রয়েছে দেওবন্দের।
দেওবন্দকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ইতিহাস
অন্তত ১০০ বছর দেওবন্দকে সরকারিভাবে একতরফা লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়নি; সমীকরণ পাল্টায় কাঠমান্ডু থেকে দিল্লিগামী একটি বিমান ছিনতাইয়ের পর। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ওই বিমানটি অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় আফগানিস্তানে।
হাইজ্যাকারদের সাথে যাত্রীদের নিরাপদ মুক্তি নিয়ে আলোচনাকালে তালেবান আলোচকরা দেওবন্দ মাদ্রাসা সফরের আগ্রহ প্রকাশ করে। এই ঘটনায় দারুল উলুমের কার্যকালাপ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পরে ভারত সরকার।
এর ব্যাখ্যা দেন দুই দশক ধরে দেওবন্দের ‘ওল্ড বয়েজ’ ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে আসা ওয়ারিশ মাজহারি। তার মতে, দেওবন্দে পড়েই সবাই দেওবন্দী হন এমন নয়। কারণ এখান থেকে পাস করা অনেকেই নিজ এলাকায় ফিরে মাদ্রাসা খুলে বসেন। গ্রাম্য ওইসব মাদ্রাসাও দেওবন্দী বা হানাফি মাযহাবের শিক্ষাকেন্দ্র বলে পরিচিত।
তিনি জানান, পাকিস্তানের দেওবন্দী মাদ্রাসায় অনেক তালেবান নেতা শিক্ষাগ্রহণ করেছেন, তারা কখনো মূল দেওবন্দে না আসলেও- নিজেদের দেওবন্দী বলে পরিচয় দেন।
কিন্তু, তালেবান নেতাদের দারুল উলুম সফরের ওই ইচ্ছেকে নানান রঙ চড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। তার ওপর আবার ওই বিমান ছিনতাইয়ের দুই বছর পরেই হয় নাইন/ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলা।
এর ফলে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পরে আফগানিস্তান ও তালেবানদের কুখ্যাতি; বিশেষ করে তারা যে আল কায়েদার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আশ্রয়দাতা সেকথা সবার মনে গেঁথে যায়।
মাজহারি বলেন, সে সময় পশ্চিমা গণমাধ্যম নিশ্চিতভাবে তালেবান ও দেওবন্দের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে বলে প্রচার করে। ফলে বিশ্বের অন্যতম সম্মানীয় এই মাদ্রাসা কালিমালিপ্ত হয়। ভারতীয় গণমাধ্যম আরও চড়াও হয়ে ওঠে; অথচ এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে উগ্র-মতাদর্শের সম্পর্ক কোনোদিনই ছিল না।
তিনি অবশ্য ‘প্রাচীন পাঠ্যক্রমগুলিকে আধুনিকীকরণ করা উচিত’; এমন মতপ্রকাশ করেন। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন আশরাফ উসমানী।
উসমানী বলেন, আমরা পাঠক্রমে আধুনিকতা যোগ করার চেষ্টা করি, ইংরেজি ও কম্পিউটার শিক্ষাও দেই। কিন্তু, তাই বলে কুরআন ও হাদিসের মতো ধর্মীয় শিক্ষা পরিবর্তন করা কীভাবে সম্ভব?
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী ডামাডোল শান্ত হলে প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো মাদ্রাসাটির ওপর চাপ কমবে কিনা তা নিয়ে এখানকার আলেম-ওলামা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এনিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদও রয়েছে। বিজেপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা অবশ্য এনিয়ে চিন্তিত নন।
নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় বিজেপির এক নেতা বলেন, আমি মনে করি না দেওবন্দের চিন্তার কোনো কারণ আছে এবং তারা এটা জানে। সাম্প্রতিক হাঙ্গামাটি আসলে নির্বাচনের সাথে যুক্ত। ভোটের পরেও গোলমাল অব্যাহত থাকবে, তা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ