আমাজন মানেই বিস্ময়। নদীর অববাহিকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন, উঁচু উঁচু গাছ, কয়েক হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, লাখ লাখ প্রজাতির কীটপতঙ্গ, পাখি-প্রাণীসহ জীববৈচিত্র্যের আধার এই বন। পৃথিবীর ২০ ভাগ অক্সিজেন আসে এই বন থেকেই। বিশ্বের প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের একটির নাম আমাজন। তবে সম্প্রতি সময়ে বারবার বিপদগ্রস্ত হয়েছে আমাজন।
আমাজনের প্রাচীন জঙ্গলে বিরাট বিরাট গাছে বাস বহু পাখির। বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল বিশেষ একটি রোগ। সমস্ত পালক হয় ঝরে যাচ্ছে, অথবা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আর তার কারণ খুঁজতে গিয়েই অবাক হলেন বিজ্ঞানীরা।
পাখিদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে পারদ। আর তার উৎস বৃক্ষগুলিই। এতদিন জলজ বাস্তুতন্ত্রে পারদ দূষণ নিয়ে নানা গবেষণা চালিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু অরণ্য অঞ্চলে পারদ দূষণের প্রভাব সামনে এল এই প্রথম। আর সেই দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রাণী, এমনকি মানুষের শরীরেও।
ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাপত্র সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ পত্রিকায়। আমাজন অরণ্যের পেরু অঞ্চলে গবেষণা চালিয়েছেন তারা। বিগত ৩ বছরের তথ্য সংগ্রহ করেছেন তারা।
এরপর পারদকেই পাখিদের রোগের কারণ বলে দায়ী করছেন। শুধু পাখিদের শরীরেই নয়, অরণ্যের বড়ো বৃক্ষদের রস পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে তাতেও যথেষ্ট পরিমাণে পারদ রয়েছে। আর সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হল, এখানেও পারদের সঙ্গে জল মিশছে। ফলে তৈরি হচ্ছে মিথাইলমার্কারি।
সাধারণত মাছেদের শরীরে পারদ প্রবেশ করলে সেখানে মিথাইলমার্কারি তৈরি হয়। তারপর ছোটো মাছদের শরীর থেকে বড়ো মাছের শরীরে এবং বড়ো মাছের শরীর থেকে ক্রমশ মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই বিষ।
তবে গাছের শরীরেও জল এবং লবন মিশে মিথাইলমার্কারি তৈরি হচ্ছে বলে মত বিজ্ঞানীদের। এর কারণ সম্পর্কেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা। দেখা যাচ্ছে, সোনা খনির আশেপাশের গাছেদের শরীরে পারদের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। সোনা পরিশোধনের কাজে পারদের ব্যবহার বহুদিনের। সেখান থেকেই গাছের শরীরে পারদ ছড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি আমাজন বনের গহিনে নদীজুড়ে বয়ে চলা উজ্জ্বল দ্যুতি নজর কেড়েছে বিশ্ববাসীর। এই উজ্জ্বল দ্যুতি আর কিছু নয়। পানির ধারার সঙ্গে মিলে চলা এ দ্যুতি সোনার। ছবি দেখে মনে হচ্ছে নদীগুলো হয়ে উঠেছে সোনার নদী।
ছবিতে দেখে স্বর্ণযুক্ত পুরো অঞ্চল ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। মহাকাশ থেকে নাসার তোলা এই ছবিগুলো বিস্ময় জাগিয়েছে। স্যাটেলাইটের ক্যামেরায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা খনিগুলোর চিত্র খুব ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু এই ছবি তোলার সময় সেখানে রোদের আলো পড়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নদীতে বয়ে যাওয়া স্বর্ণের উজ্জ্বল দ্যুতি।
এই সোনার নদী আসলে পাহাড়ের বুকে খোঁড়া অবৈধ সোনার খনির ছবি বলে ধারণা নাসার। আর এই খনির পেছনে রয়েছে অনুমোদনহীন স্বর্ণসন্ধানীরা।
দক্ষিণ-পূর্ব পেরুর মাদ্রে দে দিওসের সোনার খনির অবস্থা কতটুকু ধ্বংসাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে, সেই নজির পাওয়া যায় এই ছবিগুলোর মাধ্যমে। প্রথম সারির সোনা রপ্তানিকারক একটি দেশ পেরু। মাদ্রে দে দিওস অঞ্চলটি আমাজনের বনের মধ্যে। জীববৈচিত্র্যের জন্য বেশ সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল এটি। তবে এর পাশাপাশি এখানে রয়েছে স্বর্ণের এক বিশাল অনিবন্ধিত শিল্প। আর এখানে কাজ করে যাচ্ছেন হাজার হাজার খনিশ্রমিক।
বছরের পর বছর ধরে এই খননকাজের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাণীদের আবাসস্থল। সোনা নিষ্কাশনে ব্যবহার করা পারদের কারণে খনি এলাকার আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে বিষক্রিয়া। শুধু তা-ই নয়, পারদের বড় একটি অংশ নদী বা বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে। শ্রমিকরা যেসব গর্তে স্বর্ণের খোঁজ করেন, সেসব জলাধারের সংখ্যা অগণিত। শত শত এমন জলাধার পানিভর্তি হয়ে আছে। কাদা দিয়ে ঘিরে এবং গাছপালা পরিষ্কার করে এসব গর্ত তৈরি করা হয়েছে।
খনিশ্রমিকরা পুরনো নদীগুলো অনুসরণ করেন যেখানে খনিজ পদার্থসহ পলি জমা হয়। এই অংশটি বানর, জাগুয়ার, প্রজাপতিসহ অন্যান্য প্রাণীর আবাসস্থল। ধারণা করা হয়, খনির খননই এই অঞ্চলের বন নিধনের প্রধান কারণ। স্বর্ণ অনুসন্ধান নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছিল বেশ অনেক দিন ধরেই।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে পেরুর আমাজনে ২২ হাজার ৯৩০ একর বনভূমি স্বর্ণসন্ধানীদের কারণে ধ্বংস হয়েছে। সোনার দাম বাড়ার কারণে বৈষম্যের শিকার স্থানীয় সম্প্রদায়ের লোকজন খনিশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
খননকাজে ব্যবহৃত পারদ নদীর মাছসহ পুরো খাদ্যচক্রকেই প্রভাবিত করে। এই পারদের বিষক্রিয়ায় মানুষের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত এবং মারাত্মক বিকলাঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০১৬ সালে ব্রাজিলের শীর্ষস্থানীয় একটি জনস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কয়েকটি ইয়ানোমামি গ্রামের ৯২% মানুষই পারদের বিষক্রিয়ার শিকার। ধারণা করা হয়, নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের এলাকায় খননকাজ বৃদ্ধি পাওয়াই সহিংসতা ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির কারণ।
নদীর তীরে এবং বনের ভেতর এভাবে একের পর এক এলাকা নষ্ট করার কারণে মাটির নিচের স্তর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগুন দেওয়ার কারণে এবং বন নিধনের জন্য ব্যবহার করা যন্ত্রপাতি নিষ্ঠুর প্রভাব রেখে যাচ্ছে বন্যজীবনে। কমে আসছে বনের কার্বন নিঃসরণ ক্ষমতা।
আমাজন রেইনফরেস্টে এই খননের ক্ষতিকর প্রভাব এখন সেভাবে বোঝা না গেলেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটিকে এখন সতর্কবার্তা বলা যায়। কারণ স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলে সেটি প্রতিহত করার ক্ষমতাও বনের কমে আসবে অনেক। আর পৃথিবীর জন্য কোনোভাবেই এটি ভালো কিছু নয়।
বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, নতুন খনি অঞ্চলের চেয়ে পুরনো খনি অঞ্চলের আশেপাশে পারদের পরিমাণ বেশি। অবশ্য আধুনিক প্রযুক্তিতে কোনো উন্নতি ঘটেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, পুরনো খনি অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পারদ জমেছে। সেই তুলনায় নতুন খনি অঞ্চলে পারদ জমছে অনেক কম সময় ধরে।
পেরুর উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পারদঘটিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এতদিন এর জন্য নদীর জলকেই দায়ী করছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সেটুকুই যে কারণ নয়, তাই প্রমাণিত হল সাম্প্রতিক গবেষণায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ