নারীকে সাধারণত প্রেয়সী, মমতাময়ী, যত্নশীল, নমনীয় এবং যত্নবান হিসেবে জানি। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে এরকম অনেক নারীর দেখা মেলে যারা তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে পৃথিবীর বুকে রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন! নির্যাতন, নৃশংসতা, খুন এসব ছিল তাদের পছন্দের কাজ। বিভিন্ন সময় পৃথিবীর পুরুষদের কুকর্মের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করা হলেও নারীদের নিয়ে তেমন কোন আলোচনা চোখে পড়ে না।
ইরমা গ্রেস
জন্ম ৭ অক্টোবর ১৯২৩, র্যাচেন, জার্মানি। তিনি নাৎসিদের যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে চাকরি করতেন সেইসাথে বার্গেন-বেলসেনে নারী সেকশনের ওয়ার্ডেন ছিলেন। বেলসেনে মানবতা লঙ্ঘন করার কারণে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। মামলার বিচারে ফাঁসির রায় হয়। তিনি বিভিন্ন পন্থায় কষ্টদায়ক নির্যাতন চালাতে পছন্দ করতেন, তার পায়ে সবসময় ভারী বুট জুতো থাকত। নিজের বিভিন্ন কুকীর্তি চরিতার্থ করার জন্য তিনি একটি পিস্তলও সাথে রাখতেন। মাত্র ২২ বছর ৬৭ দিন বয়সে এই নারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বিংশ শতাব্দীতে ইংলিশ আইনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সবচেয়ে কম বয়সী নারী আসামী ছিলেন তিনি। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে, হ্যামেলিন, জার্মানিতে তিনি মারা যান। তাকে ‘বেলসেন -এর জানোয়ার’ বলে ডাকা হত।
মায়রা হিণ্ডলি
১৯৪২ সালে জন্ম এই নারী ছিলেন একজন ইংরেজ সিরিয়াল কিলার। ইয়ান ব্রাডি নামের আরেক নারীর সাথে জোট বেধে তিনি ছেলেদেরকে ধর্ষণ করার পাশাপাশি পাঁচটি শিশুকে খুন করেছেন। এই দুই নারী বারো বছরের কম বয়সী তিনজন ছেলেকে অপহরণ করেন এবং তাদেরকে ধর্ষণ করার পাশাপাশি যৌন নির্যাতন চালানোর পর খুন করেন নৃশংসভাবে। পরবর্তীতে এই তালিকায় ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী দুই কিশোরও যুক্ত হয়। তার ১৭ বছর বয়সী ভাগ্নে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। অবশ্য আদালতে তিনি সব খুনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হননি। তার বিরুদ্ধে তিনটি খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ২০০২ সালে কারাগারেই তার মৃত্যু হয়।
ইসাবেলা অফ ক্যাসটাইল
জন্ম ১৪৫১, মৃত্যু ১৫০৪। ইসাবেলা দ্য ক্যাথলিক ছিলেন ক্যাসটাইল এবং লিওন-এর রাণী। তিনি আর তার স্বামী ফ্রেডিন্যান্ড সেকেন্ড অফ আর্গন, স্পেনকে একত্রীত করে রাজ্য স্থিতিশীল করেছিলেন। এই দম্পতি রিকোনকুইস্টায় বসবাসরত মুসলিম ও ইহুদীদেরকে ধর্মান্তরিত কিংবা নির্বাসন দেয়ার জন্য কুখ্যাত। এছাড়াও ১৪৯২ সালে ‘নতুন পৃথিবী’ নামক প্রজেক্টকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য তাদের দুর্নাম রয়েছে। ধর্মান্তরিত হও নইলে নির্বাসনে পাঠানো হবে এই মর্মে ‘দ্য সার্ভেন্ট অফ গড’ নামের একটি আদেশ ক্যাথলিক চার্চ থেকে জারি করা হয়েছিল। ইসাবেলা সেই আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন।
বেভার্লি আলিট
‘মৃত্যুর পরী’ নামে খ্যাত এই নারী একজন ইংরেজ সিরিয়াল কিলার। চারজন শিশুকে খুন, তিনজন শিশুকে খুন করার চেষ্টা এবং আরও ছয় শিশুকে গুরুত্বর জখম করার জন্য তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। লিংকনশ্যাইরে অবস্থিত গ্রাণ্টথেম অ্যান্ড কেস্টিভেন হাসপাতালে নার্স হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ৫৯ দিনের ভেতরে তিনি এসব কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ছিলেন। কমপক্ষে দু’জন শিশুর শরীরে তিনি উচ্চমাত্রার ইনসুলিন প্রবেশ করিয়েছিলেন এবং আরেক শিশুর শরীরে বিশাল বুদবুদ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে তিনি এসব কুকর্ম করেছিলেন পুলিশ সেসব উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৯৩ সালে, নটিংহ্যামের ক্রাউন কোর্টে তার অপরাধের গভীরতা বিচার করে ১৩ বার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বিচারক তাকে ‘মারাত্মক বিপদজ্জনক’ হিসেবে অভিহিত করেন। শেষপর্যন্ত নটিংহ্যামশ্যায়ারের র্যাম্পটন সিকিউর হাসাপাতালে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। তিনি এখনো বেঁচে আছেন, বর্তমানে তার বয়স ৫৩ বছর । ২০২৩ সালে তার সাজার মেয়াদ শেষ হবে।
কুইন মেরি অফ ইংল্যান্ড
জন্ম ১৫১৬ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, মৃত্যু ১৫৫৮ সালের ১৭ ই নভেম্বর। তিনি ১৫৫৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের রাণী ছিলেন। প্রটেস্ট্যান্টদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর কারণে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘ব্লাডি মেরি’ নামে । রাজা অষ্টম হেনরি এবং তার স্ত্রী প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন অফ আর্গানের অনেকগুলো সন্তান ভূমিষ্ট হলেও মেরি-ই ছিলেন একমাত্র জীবিত সন্তান। ইংল্যান্ডে ক্যাথলিসিজমকে বর্বর পন্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য মেরি পরিচিত। অনেক প্রথিতযশা প্রটেস্ট্যান্টকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য হত্যা করেছিলেন এই ‘ব্লাডি মেরি’। তার ভয়ে প্রায় ৮০০ প্রটেস্ট্যান্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। তিনি জীবিত থাকাবস্থায় তারা ফিরতে পারেনি।
বেলি গানেস
ছয় ফুট লম্বা ও ৯১ কেজিরও বেশী ওজনের এই নারী অত্যন্ত শক্তিশালী। আমেরিকার সবচেয়ে অধঃপতিত এবং উর্বর মস্তিষ্কের নারী সিরিয়াল কিলার ইনি। দু’ স্বামী এবং সন্তানদেরকে খুন করার পাশাপাশি তিনি তার পাণিপ্রার্থী এবং বয়ফ্রেন্ডদেরকে খুন করেছিলেন। খুনের মোটিভ খুবই সাধারণ। নিজের লোভী মনকে তৃপ্ত করতেই তিনি খুন করতেন। লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি থেকে টাকা প্রাপ্তি, পাণিপ্রার্থী ও বয়ফ্রেন্ডদের জিনিসপত্র চুরি করা, তাদের সাথে প্রতারণা করাটাই তার উপার্জনের মূল পথ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় সাত দশক তিনি এসব করে দাপিয়ে বেড়ান। এসময়ের মধ্যে ২০ জনেরও বেশী ব্যক্তি তার শিকারে পরিণত হয়। এছাড়াও তিনি আরও ১০০ টি নানারকম মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন। তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল।
মেনি অ্যান কটন
ব্রিটেনের প্রথম সিরিয়াল কিলারের জন্ম ১৮৩২ সালের অক্টোবরে। বিশ বছর বয়সে উইলিয়াম মওব্রে নামের এক ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। বিবাহিত জীবনে তিনি পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেন, তারমধ্যে চারজনই পেটের ব্যথা ও গ্যাস্ট্রিক জনিত সমস্যার কারণে মৃত্যুবরণ করে। এসময় তিনি সপরিবারে প্লেমউথ, ডেভনে বাস করতেন। সেখান থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে তারা এলাকা বদল করেন কিন্তু দূর্ভাগ্য সেখানেও হাজির হয়। তার আরও তিনটি সন্তান হয় এবং তিনজনই মারা যায়। ১৮৬৫ সালের জানুয়ারিতে তার স্বামী উইলিয়ামও ‘অন্ত্রে গোলমাল’ হওয়ায় পরলোক গমন করেন। তার ২য় স্বামী জর্জ ওয়ার্ড পেটের পীড়ায় ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু পাপ বাপকেও ছাড়ে না। স্থানীয় পত্রিকাগুলো খেয়াল করল মেরি অ্যান উত্তর ইংল্যান্ড জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং এসময়ে তার ৩ স্বামী, ১ প্রেমিক, তার মা এবং এক ডজন সন্তান মারা গেছে। আর এরা সবাই মারা গেছে পেটের ব্যথায়। আর্সেনিক পয়জন দিয়ে এতগুলো মানুষকে হত্যা করার অপরাধে তাকে মার্চের ২৪ তারিখে, ১৮৭৩ সালে ডারহাম কাউন্টি গাওলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
ইলসি কচ
১৯০৬ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বরে জন্ম নেয়া এই নারী ‘বাউচওয়াল্ডের পেত্নী’ নামে কুখ্যাত ছিলেন। তার স্বামীর নাম কার্ল-ওটো কচ। নির্যাতন এবং অশ্লীলতা করে ইলসি কচ আনন্দ পেতেন। মানুষকে খুন করে তাদের শরীর থেকে ট্যাটু সংরক্ষণ করার কারণে তিনি কুখ্যাতি কুড়িয়ে ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ১ লা সেপ্টেম্বরে অ্যাইচাক নারী কারাগারে ফাঁস নিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
ক্যাথরিন নাইট
১৯৫৫ সালের ২৪ শে অক্টোবরে জন্ম নেয়া এই নারীকে তার কৃতর্মের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। ক্যাথরিন মেরি নাইট ছিলেন প্রথম অস্ট্রেলিয়ান নারী যাকে কোন প্যারোল ছাড়াই যাবজ্জীবন কারাদ- ভোগ করতে হয়েছে। তার ইতিহাস খুবই ভয়ংকর। তিনি তার সাবেক এক স্বামীর দাঁতের মাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। আরেক স্বামীর চোখের সামনে একটা পোষা কুকুরের বাচ্চার গলা দু’ফাঁক করে দিয়েছিলেন এই নারী। বাচ্চাটির বয়স ছিল মাত্র আট সপ্তাহ। দাম্পত্য কলহের জের ধরে তার স্বামী জন চার্লস থমাস প্রাইস তার নামে থানায় ফাইল করেন। এর ফলস্বরূপ তাকে ক্যাথরিনের হাতে খুন হয়ে যেতে হয়। মাংস কাটার ছুরি দিয়ে তার শরীরের সামনে-পেছনে অন্তত ৩৭ বার জঘম করা হয়েছিল। তার গুরুত্বপূর্ণ সব অঙ্গেও অনেক আঘাত করা হয়েছিল। তারপর ক্যাথরিন, প্রাইসের শরীর থেকে চামড়া তুলে নিয়ে সেটাকে লিভিং রুমের দরজার ফ্রেমের সাথে ঝুঁলিয়ে রাখেন। তার মাথা কেটে নিয়ে রাখেন হয় স্যুপের পটে, ঝলসে দেন নিতম্ব। তারপর তিনি চাটনি এবং সবজি ব্যবহার করে এগুলোকে খাবার হিসেবে বাচ্চাদের সামনে দেয়ার জন্য জন্য সাজিয়ে রেখেছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ বাচ্চারা বাড়িতে ফেরার আগেই পুলিশ এসব উদ্ধার করে।
এলিজাবেথ বাথোরি
জন্ম ১৫৬০, মৃত্যু ১৬১৪ সালে। কাউন্টেস এলিজাবেথ বাথোরি হাঙ্গেরি-এর সম্ভ্রান্ত বাথোরি পরিবারের কাউন্টেস ছিলেন। তাকে ইতিহাসের অন্যতম অভিজাত নারী সিরিয়াল কিলার বলে অভিহিত করা হয়। যদিও তিনি কতগুলো খুন করেছেন সেটা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। ‘ব্লাড কাউন্টেস’ নামে তার কুখ্যাতি ছিল। তিনি কৃষকদের মেয়েদেরকে পিটিয়ে, পুঁড়িয়ে, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে এবং চেহারা কামড়ে খুন করতেন। একবার গৃহবন্দী করা হলেও কাউন্টেস হওয়ার কারণে তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
তথ্যসূত্র : wonderslist.com
আপনার মতামত জানানঃ