ইউক্রেন ঘিরে সৃষ্ট অচলাবস্থায় ইউরোপে যেন যুদ্ধের দামামা বাজছে। দেশটির সীমান্তে প্রতিবেশী রাশিয়ার লাখো সৈন্য মোতায়েন আর পূর্ব ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থায় রক্তাক্ত সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে এই সংকট সৃষ্টির পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে দায়ী করেছে মস্কো। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন ঘিরে মস্কোর প্রধান নিরাপত্তা দাবিগুলোর কোনো সুরাহা করেনি ওয়াশিংটন ও ন্যাটো। এর পরিবর্তে পূর্ব ইউরোপে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছেন।
রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র: দায়ী কে?
ক্রমবর্ধমান সংকটের মাঝে কয়েক সপ্তাহের নীরবতার পর প্রথমবারের মতো টেলিফোনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ সময় তিনি ম্যাক্রোঁকে রাশিয়ার নিরাপত্তা দাবিগুলোর কথা জানান।
একই সঙ্গে ওয়াশিংটন ও ন্যাটোর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের পর চলতি সপ্তাহেই পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে পুতিন ম্যাক্রোঁকে জানিয়েছেন।
ম্যাক্রোঁর সঙ্গে পুতিনের আলোচনার বরাত দিয়ে ক্রেমলিন বলছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়ার মূল উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়নি; এই বিষয়টির প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল।
ন্যাটো জোটের সম্প্রসারণ বাতিল, রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন না করা এবং পূর্ব ইউরোপের ওয়ারশ চুক্তিতে থাকা সাবেক সদস্য দেশগুলোর ন্যাটোতে যোগদান বাতিলের দাবি জানিয়েছে রাশিয়া।
ক্রেমলিন বলছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কীভাবে নিরাপত্তা অখণ্ডতার নীতি অনুসরণ করতে চায় সেই মূল প্রশ্ন উপেক্ষা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। অন্য দেশের সুরক্ষায় কারও নিরাপত্তা জোরদার করা উচিত নয়।’
‘মস্কো যুদ্ধ চায় না’ বলে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ সমঝোতামূলক যে মন্তব্য করেছেন তার প্রতিধ্বনি করে পুতিন বলেছেন, তিনিও পরিস্থিতির তীব্রতা বাড়াতে চান না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আসন্ন হতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার পর মস্কো এই মন্তব্য করেছে।
শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোটের শক্তি বৃদ্ধি করতে তিনি ওই অঞ্চলে স্বল্পসংখ্যক সৈন্য পাঠাবেন। তবে এই সৈন্যরা কোথায় সমাবেশ করবেন অথবা কোথায় পৌঁছাবেন সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু জানাননি তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে পশ্চিম ইউরোপে কয়েক হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে।
এদিকে, রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে অহেতুক ভীতি না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি।
শুক্রবার রাজধানী কিয়েভে এক সংবাদ সম্মেলনে এই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমের কয়েকটি দেশের নেতারা এমনভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন, যেন আগামীকালই ইউক্রেনে হামলা ঘটবে। তাদের এই বিষয়ক বক্তব্য, উদ্বেগ-সতর্কবার্তার ফলে ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে।
এর ফলে আমাদেরকে কতটা মূল্য দিতে হবে? দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থার জন্য এই ভীতি খুবই ক্ষতিকর।’
গত ডিসেম্বরে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক রুশ সেনা মোতায়েনের পর থেকেই ইউক্রেনের পক্ষে সরব হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ন্যাটো। ইতোমধ্যে এই ইস্যুতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ঐক্যের ডাক দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ।
কার সামরিক সক্ষমতা বেশি?
২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। ওই বছর রাশিয়া আক্রমণ করে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। সে সময় ইউক্রেনীয় সৈন্যরা রুশ সেনাদের রুখতে প্রাণপণে যুদ্ধ করলেও তারা সফল হতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট থাকলেও তাদের অস্ত্রের অভাব রয়েছে। এই অস্ত্রের ঘাটতি মেটাতে ন্যাটোর দেশগুলো প্রকাশ্যে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে।
সম্প্রতি আমেরিকা তাদের অনেক যুদ্ধজাহাজ ও অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। এই অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, সশস্ত্র যানবাহন এবং ট্যাংক। শুধু তাই নয়, মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে বলে খবরে জানা গেছে।
তবে, ইউক্রেনের তুলনায় সামরিকভাবে এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, এই দুই দেশেরই সামরিক শক্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মোট সৈন্য যথাক্রমে ১১ লাখ এবং ২৯ লাখ। যাদের মধ্যে ইউক্রেনের সক্রিয় সৈন্য রয়েছে ২ লাখ এবং রাশিয়ার ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৯ লাখ। বাকিরা রয়েছে রিজার্ভ সৈনিকের তালিকায়। এছাড়াও, সামরিক অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধবিমান, সশস্ত্র যানবাহন প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইউক্রেনের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন ৮৫০০ সৈন্য প্রস্তুত রেখেছে দ্রুততার সাথে ইউরোপে মোতায়েনের জন্য। এরা ন্যাটোর বহুজাতিক ৪০,০০০ সৈন্যের যে ইউনিট আছে তার মার্কিনী অংশ, যারা সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেকোন আগ্রাসন ঠেকাতে সবসময় প্রস্তুত।
এ ছাড়া পোল্যান্ডে রাখা বিমান বাহিনীর বিমান, এবং এয়ারবোর্ন ডিভিশনের আরও ৩০০০ সেনা আছে পাঠানোর মত। কিন্তু এগুলো সব একত্রিত করেও রাশিয়ার সামনে দাঁড়ানো সহজ হবে না বলেই ধারণা করছে খোদ পেন্টাগন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, ইউক্রেন ঐতিহ্যগতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। ৩০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময় এটি বর্তমান রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুগ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং সামরিক ইউনিট ইউক্রেনের অংশে চলে আসে। ২০১৪ সালে যখন ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত হন তখন পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল।
কিন্তু, তাকে অপসারণের সাথে সাথেই ইউক্রেনে রাশিয়া বিরোধী সরকার চলে আসে। এর ফলে ইউক্রেনের রুশ-ভাষী অঞ্চলে উত্তেজনা দেখা দেয়। তারপরই ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া আক্রমণ করে এবং সংযুক্ত করে। ক্রিমিয়ায় রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহী ও ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে লড়াইয়ে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
তবে, বর্তমান যুদ্ধের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক সংস্থা ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। এতে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ অনেক বেড়েছে। রাশিয়া চায় না ন্যাটো তার সীমান্তে প্রবেশ করুক। ইউক্রেনের কারণে মার্কিন সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য শত্রু দেশ রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এতেই ক্ষুব্ধ তারা।
গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা ক্রমাগত ইউক্রেন সফরে আসছেন। অনেক সময় ইউক্রেন ও রাশিয়া সীমান্তে মার্কিন সেনাদেরও দেখা গেছে। রাশিয়া এটিকে একটি বিশাল হুমকি হিসেবে দেখছে এবং বারবার ইউক্রেনের সাথে উত্তেজনা বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও, রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও কিনেছে।
এদিকে, রুশ-ভাষী মানুষ ইউক্রেনের জনসংখ্যার প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ। তাই রাশিয়া দাবি করছে যে, ইউক্রেনের ওই মানুষদের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ