জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। সাগরের পানিতে অতিরিক্ত লবনাক্ততা বৃদ্ধির সাথে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে পিরোজপুরের সন্ধ্যা বলেশ্বর ও কচা নদীর তীর ঘেষা মনোমুগ্ধকর সবুজ বনায়ন।
জেলায় নদীর ভাঙনের মুখে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। মানবজীবন বিপন্নের পাশাপাশি ক্ষতির শিকার গাছপালা। জেলা প্রশাসন জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে সবুজ বনায়নের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ বন্যা, ২০০৭ সালের সিডর এবং সর্বশেষ ফনী ও বুলবুলের তাণ্ডব থেকে বাঁচাতে প্রাকৃতিক দেয়ালখ্যাত সবুজ বনাঞ্চল স্থানীয়দের জীবন বাঁচালেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ প্রাকৃতিক দেয়াল এখন সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পিরোজপুরের সাত উপজেলার ১১ লাখ সাধারণ মানুষ।
সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিটি জোয়ারে বেড়িবাঁধ বালু বা মাটির স্তর প্রতিদিনই ৫/১০ ইঞ্চি পর্যন্ত নেমে যাচ্ছে নদীর ভূ-গর্ভে। এ কারণে ভেঙে পড়েছে গাছের কাণ্ড, আবার কোনো কোনো গাছের শেকড় বের হয়ে যাওয়ায় এসব গাছ খাদ্য সংগ্রহ করতে পারছে না ফলে মারা যাচ্ছে। বিলীন হচ্ছে নদীপাড়ের কয়েক হাজার পরিবার।
স্থানীয়রা জানায়, সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থলভাগের এসব গাছের গোড়ায় জোয়ারের পানির চাপে মাটি ও বালি ধুয়ে যাওয়ায় এখন ভেঙে পড়ছে পাড়। মরে যাচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে জম্মানো অসংখ্য প্রজাতির গেওয়া, কেওড়া, ছইলা ও নারিকেল, খেঁজুর গাছ। হারিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকার সবুজ বনাঞ্চল। নদীর পাড় ও চরাঞ্চলের এ অবস্থা রোধ করা না গেলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের বসবাসে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
এদিকে জেলা সামাজিক বন বিভাগ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গত বছর এ জেলার সাত উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার বিভিন্ন গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে।
ডিসি আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে সবুজ বনায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। জলবায়ুর কারণে উপকূলীয় এলাকার বনাঞ্চল হুমকির মুখে থাকায়, কচাঁ ও সন্ধ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় লবণ সহিষ্ণু গাছ রোপণ এবং নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করে বেড়িবাঁধ দেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।
বৈজ্ঞানিক সূত্রে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় বরফ গলে যাওয়ায় সাগর তলের উচ্চতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বন বিভাগের তৈরি করা বনাঞ্চল মরে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সাগরের পানির স্তর ক্রমশই বাড়ছে। এ কারণে বেশি করে গাছ লাগালে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেতে পারে।
নদীর পাড় ও চরাঞ্চলের এ অবস্থা রোধ করা না গেলে প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হবে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের বসবাসে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় সচেতন মহলের ধারনা, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের তীব্র ভাঙন আর অন্যদিকে বনদস্যুদের অবাদে গাছ কাটার কারণেই উপকূলীয় এলাকার বন গুলোর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বনাঞ্চল রক্ষায় বর্তমান সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে চরম মূল্য দিতে হবে, যার ফলে ভবিষ্যতে প্রানীকূল মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে গত বছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল খুবই অস্বাভাবিক। এর সঙ্গে ছিল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলে একের পর এক বন্যা, ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রচুর প্রাণহানির কারণ হয়েছে। বহু দেশে প্রচুর মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। সমুদ্র ও সমুদ্র উপরস্থিত তাপমাত্রায় বড় হেরফের হয়েছে এই সময়, যা সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনে এনেছে বড় বদল। ২০২০ সালে ভারত, প্রশান্ত ও আর্কটিক মহাসাগরের গড় তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এটা অবশ্য গোটা বিশ্বেই হয়েছে। তবে এশিয়ায় হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যেমন আরব সাগরের তুলনায় এ অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে তিনগুণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠিক কতটা, তা বোঝার অন্যতম বড় মানদণ্ড হচ্ছে সাগরের বরফের উচ্চতা। কারণ, এটি শুধু ওই নির্দিষ্ট অঞ্চল নয়, গোটা বিশ্বের জলবায়ুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। গত বছর আর্কটিক সাগরের বরফের উচ্চতা ছিল ১৯৭৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এর প্রভাব পড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ওপরও। ১৯৯০-এর দশক থেকে প্রতি বছর গড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার করে বাড়ছে। বৈশ্বিক এই গড়ের চেয়ে এই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
সমুদ্রের বরফ গলার মতো করে একইভাবে গলেছে হিমবাহ। এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে ১ লাখ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত হিমবাহ, যার কেন্দ্র বলা যায় তিব্বত ও হিমালয়। মেরু অঞ্চলের বাইরে এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি বরফ, যা এশিয়ার ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নদীর উৎস। গত বেশ কয়েক বছর ধরে গলে যাচ্ছে এসব অঞ্চলের হিমবাহ। এর গতি এখন যা, তাতে এই অঞ্চলের মোট হিমবাহের ২০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে গলে যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ডব্লিউএমও-এর গবেষণা প্রতিবেদনে, যা এই অঞ্চলের অন্তত ৭৫ কোটি মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হওয়া সরাসরি প্রভাবের পাশাপাশি রয়েছে আবহাওয়াগত পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সংকট। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে শুধু বন্যায় এশিয়ার ৫ কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে ৫ হাজারের বেশি মানুষ। গত দুই দশকের তুলনায় গড়ে ক্ষতি কমে এলেও এখনও বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদির কারণে প্রতি বছর এই অঞ্চলগুলোয় বছরে গড়ে কয়েক শ কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের আওতাধীন সংস্থা এসকাপ।
এই যাবতীয় সংকট সবচেয়ে বেশি যেটি বাড়িয়ে তুলছে, তা হলো খাদ্য ও পুষ্টি সংকট। বৈরী আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পথ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৪ কোটি ৮৮ লাখ, দক্ষিণ এশিয়ার ৩০ কোটি ৫৭ লাখ মানুষ এবং পশ্চিম এশিয়ার ৪ কোটি ২৩ লাখ মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অপুষ্ট জনসংখ্যার অর্ধেকই এশিয়ার বাসিন্দা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৯
আপনার মতামত জানানঃ