বায়ুদূষণের দিক থেকে গত তিন বছরের মতো এবারও বিশ্বের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে বরাবরের মতোই শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। রাজধানীর বাতাসকে বিষিয়ে তোলার জন্য সবেচয়ে বেশি (৩০%) দায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, রাজধানীর বাতাসকে বিষিয়ে তোলার জন্য সবেচয়ে বেশি (৩০%) দায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের। ২৯% দূষণের উৎস ইটভাটা ও শিল্পকারখানা। অন্যান্য উৎসের মধ্যে যানবাহনের কালো ধোঁয়া (১৫%), আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ (১০%), গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত দূষণ (৯%) এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণে (৭%) বায়ুদূষণ হয়ে থাকে।
এদিকে, রাজধানী ঢাকার মানুষ গত ছয় বছরের মধ্যে মাত্র ৩৮ দিন ভালো বায়ু গ্রহণ করতে পেরেছে। বাকি দিনগুলোর মধ্যে ৫১০ দিন চলনসই মানের বায়ু, ৫৭৭ দিন সংবেদনশীল, ৪৪৩ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৩৮৫ দিন খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩৭ দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করে।
ছয় বছরে ৩৮ দিন ঢাকার বায়ুর মান ভালো থাকার কারণ ব্যাখ্যা করে ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) অনুযায়ী ৩৮ দিন রাজধানীর বায়ুর মান ছিল ০ থেকে ৫০, যাকে ভালো বলা হয়। ওই দিনগুলো ভারি বৃষ্টি, ঈদের ছুটি ও কঠোর লকডাউনের মধ্যে পড়েছে। এ সময়ে যানবাহন ও মানুষের চলাচল কম ছিল। কলকারখানা ও ইটভাটা বন্ধ ছিল।
ক্যাপস গবেষণায় পেয়েছে, রাজধানীর বায়ুদূষণের উৎসের একটি বড় বদল ঘটে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ছিল ইটভাটা (৫৮%)। এর এক যুগ পর ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে বায়ুদূষণের মূল উৎস বলা হয় যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়াকে (৫০%)। কিন্তু মাত্র এক বছরের মাথায় গতকাল প্রকাশিত ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বাতাসে দূষিত বস্তুর উৎস হিসেবে ইটভাটা এবং যানবাহন ও শিল্পকারখানার ধোঁয়ার স্থান দখল করেছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর নির্মাণ কাজ।
রাজধানী ঢাকার মানুষ গত ছয় বছরের মধ্যে মাত্র ৩৮ দিন ভালো বায়ু গ্রহণ করতে পেরেছে। বাকি দিনগুলোর মধ্যে ৫১০ দিন চলনসই মানের বায়ু, ৫৭৭ দিন সংবেদনশীল, ৪৪৩ দিন অস্বাস্থ্যকর, ৩৮৫ দিন খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩৭ দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ু গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতায় ঢাকায় বায়ুদূষণ বেড়েই চলছে। তিনি জানান, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ঢাকার মানুষ মাত্র ২% (৩৮ দিন) সময় ভালো বায়ু নিতে পেরেছে। ২৬% (৫১০ দিন) চলনসই মানের বায়ু, ২৯% (৫৭৭ দিন) সংবেদনশীল বায়ু, ২২% (৪৪৩ দিন) অস্বাস্থ্যকর, ১৯% (৩৮৫ দিন) খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ২% (৩৭ দিন) দুর্যোগপূর্ণ ছিল ঢাকার বায়ু। বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে ঢাকার বায়ুর মান ১২ শতাংশ খারাপ হয়েছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৫ বছরের থেকেও ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে ৭ শতাংশ।
ক্যাপসের তথ্য বলছে, ঢাকা শহরে বিকেল ৪টার পর বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে; যা রাত ১১টা থেকে ২টার মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। গত ছয় বছর রাত ১টায় বায়ুর মান ছিল ১৬২, যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বোচ্চ। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে মালবাহী প্রচুর ট্রাক ঢাকায় ঢোকে। এগুলো থেকে ধুলার পরিমাণ বাড়ে। এ ছাড়া রাতে সিটি করপোরেশন ঢাকার রাস্তা ঝাড়ূ দেওয়ার নিয়ম চালু করার পর থেকে বাতাসে ধূলাবালি বেশি উড়ছে।
সভাপতির বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ঢাকা নগরের বায়ুর মান ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে হতে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাওয়ার পরও এ ব্যাপারে নাগরিকদের অবগত না করায়, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা আছে কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ঢাকা শহরের বায়ু সম্পর্কে যথাযথ তথ্য যথাসময়ে সাধারণ মানুষকে অবগত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, বায়ু দূষণের কারণে ঢাকায় একটি মানবিক বিপর্যয় হচ্ছে এবং আমরা সেই উন্নয়ন চাই না যে উন্নয়ন জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
সংবাদ সম্মেলনে দূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার, অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়ানো, ঢাকার আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করা, নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করাসহ ১৫টি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা অভিযোগ করেন, সরকার সঠিক পরিকল্পনা নিলে ও বরাদ্দ ঠিকমতো খরচ করলে নির্মাণের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। সংবাদ সম্মেলনে শুস্ক মৌসুমে ঢাকায় দৈনিক দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানো, নির্মাণ কাজের স্থান ঢেকে রাখা, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব কংক্রিটের প্রচলন, ফিটনেসহীন গাড়ি বন্ধ করাসহ ১৫টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
একটা সময় ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হতো ইটভাটার ধোঁয়াকে। সেই জায়গা পরে দখল করে নেয় মোটরযান ও শিল্পকলকারখানার ধোঁয়া। এখন কয়েক বছর ধরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও ছোট–বড় আবাসন প্রকল্পের উন্মুক্ত পরিবেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মাণযজ্ঞ বাড়িয়েছে ধুলাদূষণ। ফলে কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ধুলার সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত বছর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশিকা দিয়েছিল, সেটির তেমন বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। নির্দেশিকায় রাস্তা নির্মাণের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, বিটুমিনের ওপর বালু না ছিটিয়ে মিনি অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, রাস্তার পাশের মাটি কংক্রিট বা ঘাসে ঢেকে দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কারের ঝাড়ুর পরিবর্তে ভ্যাকুয়াম সুইপিং ট্রাক ব্যবহার, বড় সড়কে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা বলা হয়েছিল। এর কোনোটি কার্যকর করার উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। এর আগেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, তখনো সে অনুযায়ী কিছু হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ এবং গ্যাসের কারণে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এরমধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২ দশমিক ৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছে। ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভবতীদের বিরাট স্বাস্থ্য ঝুকির মধ্যে থাকতে হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে অনেকক্ষেত্রে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি মূলত সরকারি সংস্থাগুলোর। আর ধোঁয়া ও ধুলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সিটি করপোরেশনগুলো থেকে নিয়মিত তদারকি এবং রাস্তায় পানি ছিটানোর কাজ করলেই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু এ নিয়মিত কাজটিও ঠিকমতো না করায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতির বেশি অবনতি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বিত কার্যক্রমের বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৮
আপনার মতামত জানানঃ