যুদ্ধপ্রবণ এই বিশ্বে অস্ত্রের চাহিদা বরাবরই অক্ষুণ্ণ থাকে। অস্ত্র চাহিদার ওপর নির্ভর করে বিশ্বে অস্ত্রেরও বিশাল বাজার রয়েছে। সেখানে বিশ্বজুড়ে অস্ত্র বিক্রির তালিকায় আমেরিকা শীর্ষে রয়েছে। বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়, তার এক তৃতীয়াংশ হয় আমেরিকা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে খুনের সংখ্যাও বেড়েছে। প্রতিদিনই দেশটির কোনো না কোনো অঙ্গরাজ্যে বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ মানুষ। একদিকে বন্দুক হামলা, অন্যদিকে বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যার সংখ্যায়ও রেকর্ড করছে দেশটি।
মানবাধিকার নিয়ে বুলি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রেই দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে গুম-খুন। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিতর্কে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এ সংখ্যা বছরে এক লাখ বললেও প্রকৃত সংখ্যা ৬ লাখের মতো। এর মধ্যে কিছু মানুষ ফিরে এলেও বেশিরভাগই নিখোঁজ। যা নিয়ে দিন দিন দেশটির নাগরিকদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ। অন্যদিকে, পুলিশি নির্যাতনের মাত্রাও ছাড়িয়েছে সীমা।
দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম ইনফরমেশন সেন্টারের তথ্য বলছে, পুলিশের গুলিতে গত সাত বছরে নিহত হয়েছেন সাড়ে সাত হাজার মানুষ। অত্যাচারিত হওয়ার সংখ্যা কোটির কাছাকাছি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতির মোড়ল। বিশ্বকে মানবাধিকারের সবক দেওয়া দেশটিতেই ঠিক নেই মানবাধিকার পরিস্থিতি। বাস্তবিক অর্থেই দেশটির পরিস্থিতি দিন দিন বেগতিক হচ্ছে। গুম, খুন, পুলিশি নির্যাতন যেন মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে প্রতি বছর গড়ে গুম হন সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ। কোনো কোনো বছর এ সংখ্যা ৭ লাখের উপরে থাকলেও ১৯৯৭ সালে ছিল ৯ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি। ১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা বিশ্লেষণে তা স্পষ্ট। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ মার্কিন নাগরিকরাই।
শুধু তাই নয়, পুলিশি নির্যাতনের মাত্রাও চরমে পৌঁছেছে। সারাবিশ্বে মানবাধিকার রক্ষায় মার্কিনরা অত্যন্ত সোচ্চার অথচ তাদের দেশেই ২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে পুলিশের গুলিতে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। যার কোনো নির্দিষ্ট বিচার নেই। জর্জ ফ্লয়েডের মতো আরও কয়টি ঘটনা আলোচনায় আসে। ২০২০ সালের ২৫ মে মিনেসোটা শহরের মিনিয়াপোলিসে আফ্রিকান আমেরিকান ওই ব্যক্তির পুলিশের হাতে আটকের পর নির্মম মৃত্যুর ভিডিও ভাইরাল না হলে হয়ত এরও কোনো বিচারই হতো না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র ধ্বংসের মুখে আছে বলে মনে করেন দেশটির প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ। কুইনিপিয়াক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলিং ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক জরিপে এ শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে এসব নিয়ে হতাশ প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।
সচেতন প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, অন্যের বিষয়ে বলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজের সর্ষের ভেতরে আগে ভূত বের করা।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতির মোড়ল। বিশ্বকে মানবাধিকারের সবক দেওয়া দেশটিতেই ঠিক নেই মানবাধিকার পরিস্থিতি। বাস্তবিক অর্থেই দেশটির পরিস্থিতি দিন দিন বেগতিক হচ্ছে। গুম, খুন, পুলিশি নির্যাতন যেন মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার, গুম, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সোচ্চার দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু দেশটির নাগরিকরাই দীর্ঘদিন যাবৎ গুম-খুন, পুলিশি অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ আছে, অনেকেই কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রে চলমান পুলিশি নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আসে যখন ২০২০ সালের ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে আটক করার সময় হাঁটু দিয়ে ঘাড় চেপে ধরে তাকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ।
অনলাইনে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ভিডিও ভাইরাল হলে পুলিশি নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস’ নামের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
তখনই দেশটিতে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আসে। স্ট্যাটিসটিকায় প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরই পুলিশের গুলিতে দেশটিতে প্রায় ৮১৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
দেশটিতে সর্বশেষ ৯ বছরে শুধু পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৯ হাজার ৫৮৬ জন। যদিও এই পরিসংখ্যানে ফ্লয়েডের মতো পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের হিসাবে রাখা হয়নি।
এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্রাইম ইনফরমেশন সেন্টারের (এনসিআইসি) তথ্য মোতাবেক ২০২০ সালেই দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কাছে ৫ লাখ ৪৩ হাজার ১৮ জন নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ আসে।
যদিও এফবিআই থেকে প্রাপ্ত ডাটায় জানা যায়, এর মাঝে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৭২টি অভিযোগের মীমাংসা হলেও অমীমাংসিত থেকে যায় ২ হাজার ১৪৬টি অভিযোগের।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা মানবাধিকারের ধ্বজাধারী একটি দেশের পুলিশ বাহিনী স্রেফ বলতে পারছে না ২ হাজারের ওপর মানুষ কোথায় হারিয়ে গেল।
দ্য সেন্টার ফর জাস্টিস অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিবিলিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে বলপ্রয়োগ ও নির্যাতনের মতো বিষয়ে খুব অল্প ক্ষেত্রেই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে তদন্তের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও সেই অর্থে পুলিশি নির্যাতনের বিচার ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির ঘটনা ঘটেনি।
২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পুলিশি হত্যাকাণ্ডের ৯৮.৩ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি।
গত বছর ১১ এপ্রিল জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিচার চলাকালীন বিচারস্থলের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যায় ২০ বছর বয়সী আরেক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ ডন্ট রাইট। যদিও পুলিশ দাবি করেছিল ডন্ট গ্রেপ্তার এড়ানোর চেষ্টা করছিল।
৬ আগস্ট নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের রচেস্টার শহরে পুলিশের গুলিতে মারা যান ২৪ বছর বয়সী সিমরান গর্ডন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ। গর্ডনের স্বজনদের অভিযোগ পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে হত্যা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিস্থিতি এতই খারাপের দিকে গেছে যে, জার্নালিস্ট রিসোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক তার জীবদ্দশায় পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার আশঙ্কা এক হাজার ভাগের এক ভাগ।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দেশটিতে গুলিতে মারা যান আড়াইগুণ বেশি কৃষ্ণাঙ্গ।
এত ঘটনা ও অভিযোগ, এমনকি পরিসংখ্যানও বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি শোচনীয়। তারপরও নিজের দেশের পরিস্থিতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে খুব একটা জোরালো ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না।
বরঞ্চ, মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দেশকে চাপে ফেলতে বিচারবহির্ভূত ও পুলিশি নির্যাতনের বিষয়টি সামনে আনে। এমনটাই দেখা গেছে সবসময়।
এদিকে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে এক হাজার চারশোর বেশি শিশু। এক পরিসংখ্যানে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। নিহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক রয়েছেন বলেও পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়।
সম্প্রতি ২০২১ সালের বন্দুক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, ২০২১ সালে দেশটিতে যে পরিমাণে বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা ২০ বছরের মধ্যে রেকর্ড। এবছর মারা গেছেন ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৭ হাজার। আর ২০১৯ সালে বন্দুক সহিংসতায় মারা যান ৩৮ হাজারের বেশি।
বড়দের পাশাপাশি দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরাও। এবছর দেশটিতে বন্দুক হামলায় ১৭ বছরের নিচে এক হাজার চারশো ১০ জন শিশু মারা গেছে। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ছিলো এক হাজার তিনশো ৭৫। আর ২০১৮ সালে বন্দুক হামলায় মারা গেছে নয়শো ৯১ জন শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রে এই বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় নিজ দেশের পাশাপাশি অন্যদেশের নাগরিকরাও প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২১ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক নিহত হয়েছেন। সরকার থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও দেশটিতে কমছে না এই বন্দুক হামলার ঘটনা।
১৯৯৪ সালে সেমি অটোমেটিক, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রগুলোর ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে তা তুলে নেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ আইন তুলে নেওয়ায় বন্দুক হামলার নতুন যুগ শুরু হয়। এসব অস্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে এবং বেশি সময় ধরে অনেক মানুষকে মারতে পারছে দুষ্কৃতিকারীরা। এসব হামলার কোনোটা আবার এশীয়-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের কারণে ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আক্রমণকারীরা মানুষের ভিড় আছে এমন জায়গাগুলো বেছে নিচ্ছে। এমন ভিড় যেখানে কোথাও নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাক করতে হয় না। এমনটাই বলছেন ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার জে করজিন।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, করোনাকালে মানুষের মধ্যে হতাশা বেড়েছে। সে কারণেই অস্ত্র বিক্রির হার একদিকে যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে সহিংসতার হারও। কিন্তু কীভাবে এই প্রবণতাকে বদলানো সম্ভব, তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট অভিমতে পৌঁছাতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দুক হামলার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করা কঠিন এবং কঠোর নীতি প্রণয়ন করাও কঠিন। কিন্তু বন্দুক হামলার সুযোগ বন্ধ করা তেমন কঠিন নয়। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার সারা দুনিয়াতেই আছে এবং আছে তাদের সহিংস ইচ্ছার বাহার। কিন্তু একজন সহিংস মানুষের হাতে রান্না করার ছুরি বা বেসবল খেলার ব্যাট হাতে যতটা না ভয়ংকর তারচেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে। কারণ চোখের পলকেই সে ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়তে সক্ষম। আর এ পদ্ধতিটি সন্দেহাতীতভাবে লোভনীয়।
তারা বলেন, কথা খুব স্পষ্ট যে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে ক্রাইস্টচার্চ হামলার পর নিউজিল্যান্ড যে ধরণের নীতি গ্রহণ করেছে, একই রকম নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা কমতে পারে। কিন্তু এভাবে সব বন্দুক হামলায় মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে না। যেমন সম্ভব হবে না সংবিধান সংশোধন করার মাধ্যমেও। যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা, ব্রাজিলের বন উজাড় হওয়া বা চীনের বায়ু দূষণের মতোই ভয়াবহ। মানবসৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় বন্ধ করা কঠিন এবং রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভবও নয়। তবে তাই বলে সাহসী মানুষের অভিযাত্রা থেমে থাকবে কেন?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৪
আপনার মতামত জানানঃ