দেশের সবকিছু আগের মতোই চলছে। এমনকি বাণিজ্য মেলাও বন্ধ হয়নি। এমনকি বাণিজ্য মেলায় যাতে মানুষ যাতায়াত করতে পারেন তার জন্য বিশেষ বাস সার্ভিস রাখা হয়েছে। খেলোয়াড়েরা করোনায় আক্রান্ত হলেও চলছে বিপিএল।
এসবের মাঝে সরকারের কাছে করোনা মোকাবিলার একমাত্র সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসনের নামান্তর।
দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন সংক্রমণের জ্যামিতিক ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে অনঢ় নির্বাচন কমিশন৷ তারা বলছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা সংক্রমণ তেমন নেই৷ তাই নির্বাচনে অসুবিধা নেই৷
শুধু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তা কার্যকরও হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এমন পদক্ষেপে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। দেশের সব স্কুল, কলেজ আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার৷ সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক৷
বিশ্লেষকদের মতে, করোনা নয় বরং শাবিপ্রবির আন্দোলন যাতে গণ আন্দোলনে রূপ নিতে না পারে, সেজন্যই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
করোনার মধ্যেই নির্বাচন, বাণিজ্য মেলা
বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ এখন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে৷ ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণের হার ৩২.৪ ভাগে দাঁড়িয়েছে৷ এপর্যন্ত গড় সংক্রমণ হার ১৪.০৫ ভাগ৷ ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ হাজার ৩৩ জন৷ মারা গেছেন ১৮ জন৷
দেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা চার হাজার ৫৭৪টি৷ সব মিলিয়ে আট ধাপে চার হাজার ১৩৮টি ইউনিয়নে ভোটের ব্যবস্থা করেছে ইসি৷ এরইমধ্যে তিন হাজার ৭৭৩টি ইউনিয়নে ভোট শেষ হয়েছে৷ ষষ্ঠ ধাপে ৩১ জানুয়ারি ২১৯ ইউপিতে, সপ্তম ধাপে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৩৮ ইউপিতে এবং অষ্টম ধাপে ১০ ফেব্রুয়ারি আট ইউপিতে ভোট হবে৷
আগামী ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপে দেশের ২১৯টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনে ভোট নেয়া হবে৷ শেষ সময়ে এখন ওইসব এলাকায় প্রচার প্রচারণা তুঙ্গে৷
নির্বাচন কমিশন স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু করার নির্দেশ দেয়ার কথা বললেও বাস্তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই নেই বলে স্থানীয় পর্যায় থেকে জানা গেছে৷ আর নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনেও তা দেখা গেছে৷
করোনার বিধিনিষেধের মধ্যেই নির্বাচন হলেও বাস্তবে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না৷ সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক এসব ছিলো বিরল৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে জার্মানি বা ইউরোপের বাস্তবতা মিলালে চলবে না৷ এই করোনার মধ্যেও ভারতে পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে৷ প্রাদেশিক নির্বাচনের তফসিল দেয়া হয়েছে৷’’
ভোট দিতে গেলে ভোটারদের করোনার টিকার সার্টিফিকেট লাগবে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সব মানুষকে তো করোনার টিকা দেয়া যায়নি এখনো৷ আর ভোট তো সাংবিধানিক অধিকার৷ ফলে ভোট দিতে করেনার টিকা দেয়ার সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করা হলে সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন হবে৷’’
এদিকে, সরকারের বিধি নিষেধ ঘোষণার পর বাণিজ্য মেলায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছিল রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। কিন্তু বাস্তবে বাণিজ্যমেলায় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হচ্ছে।
কেউ মাস্ক না পরলেও তাকে মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে। শুধু ভলানটিয়াররাই নয়, মেলায় মাইকের মাধ্যমে মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বিষয়ে বার বার ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে কিছু দর্শনার্থী সচেতন থাকলেও অধিকাংশ দর্শনার্থীকে মাস্ক ছাড়া মেলায় ঘোরাফেরা করলেও, ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
মেলায় বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নের কর্মীরা মাস্ক পরিধান করলেও কেউ কেউ নাকের নিচ নামিয়ে রাখছে। তবে শিশুদের খেলাধুলা করার সময় মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সবচেয়ে উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে অধিকাংশ অভিভাবকদেরও মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।
এছাড়া মেলায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবিধি উপক্ষিত হয়েছে খাবার স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোতে। মেলায় ঘুরতে গিয়ে দর্শনার্থীরা খাবার স্টলগুলোতে ভিড়ও করছেন বেশি।
করোনা নয়, সমস্যা যখন ছাত্র-আন্দোলন
সরকার যে ১১ দফা বিধিনিষেধ দিয়েছে তাকে প্রকাশ্যে কোনো সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ৷ ঘরোয়া অনুষ্ঠানেও সর্বোচ্চ ১০০ জনের বেশি উপস্থিতি না করা হয়েছে৷
কিন্তু ইউপি নির্বাচনে শত শত কর্মী সমর্থক নিয়ে প্রার্থীরা প্রচার চালাচ্ছেন৷ সভা-সমাবেশ করছেন৷ স্থানীয় প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা৷
এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, গন্ডগ্রামে নির্বাচন হচ্ছে৷ আমার জানামতে সেসব এলাকায় করোনার কোনো হটস্পট নাই৷ ঢাকা শহরে একজন দাঁড়ালে সেখানে শত লোক ভিড় করে৷ গ্রামে সেরকম না৷
আমরা সরকারের যে নির্দেশনা আছে সেটা মেনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই নির্বাচনের আয়োজন করছি৷
তার মতে, এই নির্বাচন কশিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ এখন যদি নির্বাচন বন্ধ করা হয় তাহলে জট তৈরি হবে৷ নতুন কমিশন আসার পর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে৷
তার কথা, ‘‘ওইসব এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কী না তা মনিটরিং করা নির্বাচন কশিমনের পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমরা মানতে বলেছি৷ দেখার দায়িত্বে প্রশাসন আছে তারা দেখবে৷’’
এদিকে করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যে সেশন জট নামক ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা খাতে তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি মারাত্মক সমস্যা।
দেখা যায় সেশন জটের কারণে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) শেষ করতে লেগে যায় ছয়–সাত বছর, যা একজন শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার ও চাকরি জীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তবে এ নিয়ে চিন্তিত নয় কর্তৃপক্ষ। তারা চিন্তিত নির্বাচন নিয়ে।
এবার আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিসহ বিভিন্ন বর্ষের চলমান পরীক্ষাগুলো স্থগিত করা হয়েছে। অনেক বিভাগের আর মাত্র এক-দুটি পরীক্ষা বাকি ছিল। অথচ পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করায় তারা আবার পিছিয়ে পড়লেন।
অনলাইন শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু দেশের প্রায় ৯৪ ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষার বাইরে ছিলেন বলে পত্রিকায় এসেছে। তাই কোনো রকম গবেষণা বা পর্যালোচনা ছাড়া এভাবে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা সমগ্র শিক্ষার্থী সমাজকে চরম সংকটের মুখোমুখি করবে।
অথচ ১০ জানুয়ারি ডয়েচে ভেলে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার ওমিক্রনের বিস্তারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে টিকায় জোর দেয়ার কথা জানায়। যারা টিকার একটি ডোজও পায়নি এমন শিক্ষার্থীরা আপাতত অনলাইনে ক্লাস করবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী৷
সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘গত বছর সংক্রমণের যে পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছিল, এখন সংক্রমণ বাড়লেও পরিস্থিতি ঠিক সেই পর্যায়েই রয়েছে৷ তাই আপাতত আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের চিন্তা করছি না৷
আমরা বরং শিক্ষার্থীদের সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে এসে ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছি৷ কারণ এখনকার যেই ওমিক্রন, তাতে শিক্ষার্থীরা বাসায় থাকলেও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকি থাকছে৷”
এর মধ্যে গত ১৩ জানুয়ারি শাবিপ্রবির সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমদ লিজার অসদাচরণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পরদিন শুক্রবার থেকে ছাত্রীরা প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ তিন দফা আন্দোলন শুরু করলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথম দিকে তা গুরুত্ব দেয়নি।
এ নিয়ে আল্টিমেটাম দিয়েও কাজ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এরপর রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে উপাচার্যকে মুক্ত করতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এতে আরও বড় অসন্তোষের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের অপসারণের দাবি ওঠে।
এর মাঝেই বন্ধ হয়ে করে দেয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবকিছু চালু রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অযৌক্তিক।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ