শিম্পাঞ্জি নিকটতর প্রজাতি হলেও শুয়োর কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই মানুষের পরিত্রাতা হয়ে উঠছে। এই যেমন মানুষের হৃদপিণ্ড বা কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে শিম্পাঞ্জির চেয়ে বেশি নিরাপদ, মানানসই ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে শুয়োরের হৃদপিণ্ড বা তার জিনগত ভাবে উন্নত করা কিডনি।
এরই মধ্যে সাম্প্রতিক গবেষণা জানাল, কোভিড প্রতিরোধেও মানুষকে অনেক বেশি আশার আলো দেখাতে পারে শুয়োরই। শুয়োরের শ্বাসনালীর কোষগুলির মধ্যেই রয়েছে সেই জাদুমন্ত্র! যাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে মানবদেহেও কোভিডের সংক্রমণ হয়তো গোড়াতেই রুখে দেওয়া সম্ভব হতে পারে।
তার জন্য শুয়োরের দেহকোষ থেকে কী কী জানা প্রয়োজন, তা জানা গেল সাম্প্রতিক একটি গবেষণায়। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সেল ডেথ ডিসকভারি’-র সাম্প্রতিক সংখ্যায়।
গবেষণাপত্রটি পিয়ার রিভিউ করেছেন বিশেষজ্ঞদেরই একাংশ। তবে অন্য বিশেষজ্ঞরা এ-ও জানিয়েছেন, এই ধরনের বহু গবেষণা হচ্ছে। কোনও একটি গবেষণার ফলাফল যা জানাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই অন্য গবেষণার ফলাফলে তার বিপরীত ছবি বেরিয়ে আসছে।
অল্প সময়ে কাজ করতে গিয়ে করোনা নিয়ে গবেষণার মান অন্য গবেষণার মানের চেয়েও কিছুটা নেমে গিয়েছে। অনেক সময় পিয়ার রিভিউ হওয়া কোনও গবেষণাপত্র নিয়েও তাই বিতর্ক দানা বাঁধছে।
এই গবেষণার ফলাফল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (‘হু’) বা আমেরিকার ‘সেন্টার্স ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)’ অনুমোদন করেছে কি না তা এখনও জানা যায়নি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় না শুয়োর
গত দু’বছরের অতিমারি পর্বে বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শুয়োরের দেহে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের কোনও প্রজাতি (‘স্ট্রেন’) বা রূপ (‘ভেরিয়্যান্ট’)-ই সংক্রমণ ঘটাতে পারে না।
শুয়োরের শরীরে ঢুকতে পারে, শুয়োরের দেহকোষে পৌঁছে নিজের স্পাইক প্রোটিন দিয়ে নোঙরও ফেলতে পারে করোনাভাইরাস।
কিন্তু তার পর আর শুয়োরের কোষের ভিতরে ঢুকতে পারে না। ফলে, নিজেদের বংশবৃদ্ধিও ঘটাতে পারে না। তাই কোভিডে সংক্রমিত হয় না শুয়োররা। অন্য শুয়োর বা অন্যান্য প্রাণীকে কোভিডে সংক্রমিতও করে না।
কিন্তু করোনাভাইরাস কেন পারে না শুয়োরকে সংক্রমিত করতে, তার কারণ জানা যায়নি এত দিন। সেই কারণটিই জানাল আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এই গবেষণা।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের কথায়, এর ফলে, কোভিড চিকিৎসায় একেবারে নতুন একটি পথ খুলে যেতে পারে ভবিষ্যতে। যার ফলে, শুয়োরের মতোই আর কোভিডে সংক্রমিত হবে না মানুষ।
গবেষকরা দেখেছেন, করোনাভাইরাস পরিবারের অন্য সদস্যরা এর আগেও শুয়োরের দেহে ঢুকেছে। কিন্তু তাদের সংক্রমিত করতে পারেনি। কারণ, শুয়োরের দেহকোষ বহিরাগত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে লড়াইটা অন্য ভাবে করেছে।
এর কারণ কী?
কোন ভাবে? তা বুঝতে একটি পরীক্ষা চালান গবেষকরা। গবেষণাগারে শুয়োর ও মানুষের শ্বাসনালীর কালচার করা কোষগুলির একেবারে বাইরের স্তরে (‘এপিথেলিয়াল সেল্স’) করোনাভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন, ভাইরাসকে রুখতে শুয়োর আর মানুষের শ্বাসনালীর কোষগুলি কী কী কাজ করে। কীভাবে কাজ করে।
গবেষকরা দেখেছেন, সেই সময় যে কোষগুলির উপর এসে বসেছে বহিরাগত ভাইরাস, সেগুলিকে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় দেহকোষে। আদতে যা কোষগুলির আত্মহননের প্রক্রিয়া। যার নাম— ‘সেল্স ডেথ প্রসেস’। সেটা যেমন শুয়োরের দেহকোষে হয়, হয় মানুষের দেহকোষেও। তবে একই ভাবে হয় না। একই হারেও হয় না।
দেখা গিয়েছে, শুয়োরের শ্বাসনালীর বাইরের স্তরের কোষগুলিতে তখন একটি প্রক্রিয়া শুরু হয় যার নাম— ‘অ্যাপোপ্টোসিস’। কোষ মেরে ফেলার প্রক্রিয়া। কোষগুলির আত্মহননের প্রক্রিয়া। কিন্তু খুব নিয়ন্ত্রিত ভাবে। বেছে বেছে।
তবে উপদ্রুত কোষগুলিতে মারতে গিয়ে আশপাশের সুস্থ, সবল কোষগুলিরও মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয় না। উপদ্রুত কোষগুলিকে বেছে নিয়ে মেরে ফেলার প্রক্রিয়াটা যতটা নিয়ন্ত্রিত ভাবে হয় শুয়োরের দেহে, মানুষের শ্বাসনালীর কোষগুলির বাইরের স্তরে কাজটা সেই ভাবে হয় না।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে রেখে গবেষকরা দেখেছেন, করোনাভাইরাস শরীরে ঢোকার পর শুয়োরের শ্বাসনালীর বাইরের স্তরের উপদ্রুত কোষগুলির কেন্দ্র হঠাৎ ভেঙে যেতে শুরু করে। টুকরো টুকরো হয়ে যায়। যে শুয়োরে শরীরে করোনাভাইরাস ঢোকেনি, তাদের ক্ষেত্রে এটা হয় না।
কোষের কেন্দ্রস্থল ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে তো কোষটিরই আর কোনও অস্তিত্ব থাকে না। ফলে, তার ভিতরে করোনাভাইরাসের ঢুকে পড়ারও আশঙ্কা থাকে না।
কোষে ঢুকতে পারলেই ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারে। কোষের বাইরে নোঙর ফেলে আর সেটা করতে পারে না ভাইরাস। তাই শুয়োরের দেহে কোভিড সংক্রমিত হতে পারে না।
যেভাবে শুয়োর হয়ে উঠতে পারে পরিত্রাণদাতা
শুয়োরের শ্বাসনালীর কোষগুলির এই আত্মহননের প্রক্রিয়া যত তাড়াতাড়ি শুরু হয় ততই বাড়ে সংক্রমণ রোখার কাজের গতি। মানুষের কোষেও এই অ্যাপোপ্টোসিস হয় না। হয় কোষের আর এক ধরনের মৃত্যু-প্রক্রিয়া। যার নাম— ‘নেক্রোসিস’।
যা শুয়োরের মতো নিয়ন্ত্রিত ভাবে হয় না। এর হারের নিরিখেও মানবকোষের চেয়ে ১০০ গুণ এগিয়ে শুয়োরের শ্বাসনালীর বাইরের স্তরের কোষগুলি। মানুষের উপদ্রুত সব কোষই সঙ্গে সঙ্গে এই আত্মহননের প্রক্রিয়া শুরুও করে না। অনেক কোষ তা করেই না।
এই বিলম্ব ঘটায় বা আত্মহননের পথে সব ধরনের মানব দেহকোষ না হাঁটায় ভাইরাস মানুষের কোষের ভিতরে ঢোকার সুযোগ ও সময় পেয়ে যায়। তখনই শুরু হয়ে যায় তার দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি। যা মানুষের পক্ষে কাল হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, কোভিডের সংক্রমণ রুখতে এ বার তাদের লক্ষ্য, নেক্রোসিস-এর পরিবর্তে মানুষের শরীরে অ্যাপোপ্টোসিস চালু করানো যায় কি না চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে তা দেখা।
তা সম্ভব হলে এই পদ্ধতিতে মানুষের শরীরেও কোভিডের সংক্রমণ গোড়াতেই রুখে দেওয়া যাবে শুয়োরের শ্বাসনালীর উপদ্রুত কোষের শেখানো উপায়েই। প্রতিস্থাপিত কিডনি বা হৃদপিণ্ডের পর কোভিড সংক্রমণ-মুক্তিতেও হয়তো ফের মানুষের ‘পরিত্রাতা’ হয়ে উঠবে শুয়োরই!
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ