আরবের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেন। এর ওপর মধ্যপ্রাচ্যের মোড়ল সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট গত সাত বছর ধরে দেশটির ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াইয়ে ইয়েমেনের কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো খাত প্রায় ধ্বংসের মুখে। এদিকে ইয়েমেনে সৌদি জোটের বিভিন্ন রকম হামলা অব্যাহত রয়েছে।
ইয়েমেন সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই; জাতিসংঘের এই কথাকে পাত্তা না দিয়েই প্রায় সাত বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ বেছে নেওয়ার জন্য যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে বারবারই আহ্বান জানিয়েও সাড়া মেলেনি। ইয়েমেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতিই হতে দেখা গেছে শুধু। বেড়েছে মানুষের দুর্দশা।
গত কয়েক দিনে সানা ও সাদা শহরে হুথিদের ওপর হামলা চলেছে। মানবিক সংকটে থাকা দেশটি আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।
গত সোমবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেশ কয়েকটি স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায় হুথি বিদ্রোহীরা। আবুধাবির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্মাণাধীন বর্ধিত অংশেও হামলা হয়। এরপরই ইয়েমেনে উত্তেজনা বেড়েছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, জাতিসংঘের হিসাবে সংঘর্ষে গত বছরের শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। গত বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বলেছে, ৬০ শতাংশ প্রাণহানি হয়েছে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ এবং বিভিন্ন রোগে। আর বাকি প্রাণহানি হয়েছে বিমান হামলা এবং সম্মুখসারির যুদ্ধে। জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক এ সংস্থা আরও বলেছে, অপুষ্টি, দুর্বলতা ও সংঘাতের কারণে সৃষ্টি সামাজিক সংকটের কারণে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলছে, ইয়েমেনের ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষ অথবা জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ খাদ্যসংকটে রয়েছে। ৫০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে আর ৫০ হাজার মানুষ এর মধ্যেই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির শিকার।
ইয়েমেনের সহিংসতা শুরুর পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আর এতেই খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, এমন নারীদের অপুষ্টিও বড় উদ্বেগের কারণ। ডব্লিউএফপি সতর্কতা জারি করে বলেছে, এই দুই দল অপুষ্টির শিকার।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব বলছে, সহিংসতার কারণে ৪৬ লাখ ইয়েমেনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এ বছরের প্রথম দুই সপ্তাহে ৩ হাজার ৪৬৮ জন বা ৫৭৮ পরিবার গৃহহীন হয়েছে।
ইয়েমেনের ঘরহারা এসব মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ইউএনএইচসিআরের হিসাব বলছে, ইয়েমেনের ৬৭ শতাংশ জনগণ ঘরহীন হয়ে পড়েছে। আর ২৬ লাখ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে রয়েছে। ঘরহারা এসব মানুষের ৭৯ শতাংশ নারী ও শিশু।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইয়েমেনের সহিংসতা অবসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। দেশটিতে ভবিষ্যৎ খুবই অনিশ্চিত। এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘ সতর্কতা জারি করে বলেছে, ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সব দেশই জেতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবের ইয়েমেনে নিযুক্ত বিশেষ দূত হ্যানস গ্রান্ডবার্গ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেছেন, সাত বছরের যুদ্ধে সব পক্ষ একে অন্যের ক্ষতি করেছে। যুদ্ধের এই ময়দানে কোনা সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের হিসাবে সংঘর্ষে গত বছরের শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৭ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।
২০১৫ সালের শুরুর দিকে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার মুখে সৌদি-সমর্থিত ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর আল হাদি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ক্ষমতাচ্যুত এই প্রেসিডেন্টকে ফেরাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছেন এবং এ গৃহযুদ্ধ প্রতিযোগী আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে একটি ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
বিতর্কিত সেই অভিযানের শুরুর পর ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়ার পরিবর্তে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে ইয়েমেনে কার্যত দুই শাসক গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতার ওপর ভর করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এখনো মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, অপর দিকে উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হুথি বিদ্রোহীরা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে প্রায় সাত বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। দেশটির বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের যুদ্ধের আড়ালে আদতে লড়াই চলছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে। ওদিকে আবার সৌদি আরব ও ইরানের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো পরাশক্তিরা। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ছে ইসরায়েল। ইয়েমেনের হাউছি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আবদুল মালিক আল-হাউছির দাবি, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের দেশগুলো গোপনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করছে। তারা মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাতে লিপ্ত। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে সৌদি আরবের শাসকরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট করেছে।
২০১৫ সালের শুরুর দিকে রাজধানী সানা আক্রমণ করে মানসুর হাদির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে হুথি বিদ্রোহীরা। হাদি বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে ২০১৫ সালের মার্চে হাদি সরকারকে আবারও ক্ষমতায় আনতে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট।
হুথিদের পরাজিত করে ইয়েমেন থেকে ইরানের প্রভাব মুছে দিতে জোটটি বিমান হামলা চালাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকেও সৌদি জোটকে সহযোগিতা করা হয়। যুদ্ধের শুরুর দিকে সৌদি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের অবসান হবে।
তবে অভিযানের প্রায় সাত বছর হতে চললেও ইয়েমেন থেকে সরে আসেনি সৌদি জোট। বরং এ যুদ্ধকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখা হয়ে থাকে এখন। বর্তমানে রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বেশির ভাগ এলাকা হুতিদের দখলে। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা মারিবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আছে সৌদি সমর্থিত মানসুর হাদির অনুগতরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বরের শুরু নাগাদ ইয়েমেনে ১ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আরেক সংস্থা ইয়েমেন ডেটা প্রজেক্ট বলছে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় ৮ হাজার ৭৮০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়েমেনে লড়াইরত দুই পক্ষই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে থাকতে পারে।
ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযান শুরুর পর গত প্রায় সাত বছরে দেশটির মৌলিক সেবাব্যবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ইয়েমেনের দুই–তৃতীয়াংশ জেলার মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন এলাকায় সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
সাত বছর আগে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মারিব প্রদেশে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। তবে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন শহরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে এসব শহরের লাখো মানুষ অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল এলাকাগুলোতে পালাতে শুরু করে। অনেকে মারিবে আশ্রয় নেয়। এর পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমিতে অনেকগুলো অস্থায়ী তাঁবুতে গড়ে উঠেছে আল সুমিয়া আশ্রয়শিবিরটি। অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষের বসবাস সেখানে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মুখপাত্র (আইওএম) অ্যাঞ্জেলা ওয়েলস গত নভেম্বরে জানান, শুধু ওই মাসেই প্রায় ৬০টি পরিবার নতুন করে আল সুমিয়া শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। ইয়েমেন সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মারিব প্রদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য প্রায় ১৩৯টি আশ্রয়শিবির স্থাপন করা হয়েছে। এসব শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২২ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ১২ ডিসেম্বর নাগাদ দেশটিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, যুদ্ধকবলিত দেশটিতে পরীক্ষা ও তথ্য পাওয়ার সুযোগ কম থাকায় বাস্তব চিত্র তুলে ধরা কঠিন। দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী এবং ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে টিকা দিতে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সংঘাতজর্জর দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই ইয়েমেন সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের ফলে দেশটি বর্তমানে ইতিহাসের চরম মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে। অচিরেই এই যুদ্ধ থামানো না গেলে বিশ্ব একটি মানব সভ্যতাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৩
আপনার মতামত জানানঃ