অত পানি নেই আমাদের চাঁদের। এই সৌরমন্ডলের প্রায় শেষ প্রান্তেও রয়েছে আটলান্টিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের মতো মহাসাগর! যেখানে কোনো অভাবই নেই পানির! একেবারে আদিগন্ত, অতলান্ত মহাসাগর।
হ্যাঁ, সূর্য থেকে অত দূরেও। শনির চাঁদ—মিমাস-এ সেই পানি আমাদের এই গ্রহের মতোই রয়েছে একেবারে তরল অবস্থায়। খবর সায়েন্স নিউজের
সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ শনির চাঁদগুলোর মধ্যে আটটি প্রধান। এর মধ্যে আছে মিমাস। এই উপগ্রহের পরিবেশ অনেকটা পৃথিবীর মতো উষ্ণ। এতে আছে মহাসাগর। অন্তত ২৪ থেকে ৩১ কিলোমিটার পুরু বরফে আচ্ছাদিত মিমাস।
মহাসাগরের তরল পানির স্পর্শ পেতে বরফের পুরু আস্তরণ ভেদ করতে হবে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গবেষকরা। তারা উপগ্রহটি থেকে সংগ্রহ করা ক্যাসিনি মিশনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে সেখানে মহাসাগর থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। এই মিশন যৌথভাবে পরিচালনা করছে নাসা নেতৃত্বাধীন তিনটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। শনি ও এর উপগ্রহগুলো সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাচ্ছে তারা। গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, আমাদের সৌরজগতে পৃথিবীর মতো অন্যত্র এমনই উষ্ণ পরিবেশ আছে।
মিমাস এতদিন একটি গর্তেভরা উপগ্রহ হিসেবে পরিচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন সাউথওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. আলিসা হোদেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করতাম, সেখানে শুধু বরফই আছে। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় পাওয়া তথ্যে মনে হচ্ছে, এই সৌরব্যবস্থায় বসবাসের জন্য আরও অনেক জায়গা আছে।
এদিকে পৃথিবীর মতোই শনির চাঁদ ‘এনসেলাডাস’-এর সুবিশাল মহাসাগরের জল প্রতি মুহূর্তে আলোড়িত হচ্ছে। ঘূর্ণিও হচ্ছে সেই মহাসাগরে। শনির চাঁদের মহাসাগরের জল গরম হয়ে গিয়ে ওজনে তুলনায় হাল্কা হয়ে উপরে উঠে আসছে। তার পর চাঁদের পিঠের হাড়জমানো ঠান্ডার জেরে তা ফের শীতল হয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে। এই ভাবে প্রতি মুহূর্তেই আলোড়িত হচ্ছে শনির একটি চাঁদ এনসেলাডাসের মহাসাগর। মহাসাগরের এই উথালপাথাল তার সক্রিয় থাকারই প্রমাণ।
২০১০-এ শনির মুলুকে পাঠানো মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’ যে খবর পাঠিয়েছিল, তাতে পৃথিবীর মহাসাগরগুলির গড় গভীরতা যেখানে ৩.৭ কিলোমিটার, সেখানে এনসেলাডাসের মহাসাগরের গড় গভীরতা কম করে ৩০ কিলোমিটার। যার মধ্যে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঢাকা পুরু বরফের আস্তরণে। সেই বরফের আস্তরণটি রয়েছে এনসেলাডাসের ভূপৃষ্ঠের নীচের ক্রাস্টে।
তার অনেক আগেই অবশ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়েছিল এনসেলাডাস। ১৯৮১-তে সৌরমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পথে শনির চাঁদের কান ঘেঁষে যাওয়ার সময় নাসার মহাকাশযান ‘ভয়েজার-২’ দেখেছিল শনির চাঁদের পিঠ থেকে উঠে আসছে ছোট ছোট বরফের গোলক। যা সূর্যের আলোয় চকমক করছে। সেই প্রথম বোঝা গিয়েছিল ভূতাত্ত্বিক রদবদল এখনও প্রতিনিয়তই চলছে শনির চাঁদের মুলুকে।
২০১০-এ ‘ক্যাসিনি’ ছবি পাঠিয়েছিল এনসেলাডাসের পিঠের বরফে ফাটল ধরায় তার ফাঁকফোকড় দিয়ে উঠে আসছে তরল জলের ধারা। যেগুলিকে ‘গেসার’ বলা হয়।
শনিকে এক বার প্রদক্ষিণ করতে এনসেলাডাসের সময় লাগে পৃথিবীর এক দিনের আয়ুর একটু বেশি। ১.৩৭ দিন। প্রদক্ষিণ করার পথে কাছে এলে শনির অভিকর্ষ বলের টান জোরালো হয় এনসেলাডাসের উপর, দূরে গেলে তা কমে। এই বাড়া-কমার ফলে শনির চাঁদের অন্দরে তৈরি হয় প্রচণ্ড তাপ। সেই তাপই নীচের বস্তুকে ঠেলে উপরে তুলে দেয়। উপরের ঠাণ্ডা বস্তুকে নামায় নীচে। একে বলে ‘জিওথার্মাল অ্যাক্টিভিটি’। এই সবের জন্যই এনসেলাডাসের পিঠ আর তার নীচের পুরু বরফের আস্তরণে ফাটল ধরে। আর তখনই সেই ফাটলের ফাঁক গলে নীচের অতলান্ত মহাসাগরের জল ফোয়ারার মতো উঠে আসে উপরে। তার পর ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে তা বরফে পরিণত হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এনসেলাডাসের অন্দরের প্রচণ্ড তাপই নীচের মহাসাগরের জলকে তরল অবস্থায় রাখে। তা জমে গিয়ে বরফ হতে দেয় না। আর সেই তাপের জন্যই এনসেলাডাসের অন্দরে থাকা মহাসাগরের জলের স্তরের ওঠা-নামা হয়। নীচের উষ্ণ জল উপরে উঠে আসে। উপরের শীতল জল নীচে নেমে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ