গত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানুষ সরকারের মদতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ জাতিসংঘের। তবে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে এবার ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে ভয় দেখিয়ে তাদের বিবৃতি পরিবর্তনের অভিযোগ উঠেছে।
পাশাপাশি সম্প্রতি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এইচআরডব্লিউ উল্লেখ করেছে, অভিযোগের বিপরীতে বাংলাদেশ সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং ভুক্তভোগীদের পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছে।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলো জানিয়েছে, অফিসাররা তাদের বাড়িতে যেয়ে তাদেরকে হুমকি দিচ্ছেন। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে গুম করা হয়নি, এ ধরণের মিথ্যা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করছেন তারা।
মূলত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিসএপিয়ারেন্স বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ এবং এর প্রতিকারের জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়েছে। এই চাপ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগসহ হয়রানি করছে।
দেশটির রাজধানী ঢাকার বাসাবোর একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জাহিদ হাসান শাকিলের সাথে গত ১০ জানুয়ারি এক অপ্রত্যাশিত অতিথির দেখা হয়। স্থানীয় থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর তার বাসায় আসেন এবং তাকে সন্ধ্যা নাগাফ থানায় যেতে বলেন। পুলিশ শাকিলকে তার নিখোঁজ ভাইয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়।
আট বছর আগে ২০১৩ সালের ৮ ডিসেম্বর শাকিলের ভাই বিরোধী দল বিএনপির সদস্য মাহবুব হাসান সুজনকে এই একই পুলিশ বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে সুমনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুমন প্রায় ৬০০ নিঁখোজ মানুষের একজন। এই নিখোঁজদের মধ্যে বিরোধী দলীয় নেতা আছেন, এক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এমনকি ব্যবসায়ীও আছেন। এরা সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই ‘জোরপূর্বক নিখোঁজ’ হয়েছে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং মিডিয়া বিস্তারিত প্রমাণসহ এটা দেখিয়েছে যে, এই গুম ও গোপন আটকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি জড়িত ছিল।
শাকিল সংবাদমাধ্যম টিআরটিকে জানান, এতগুলো বছর পুলিশ আমার ভাইকে খুঁজতে কোনও প্রকার আগ্রহ দেখায়নি। প্রত্যেকটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দরজায় আমরা কড়া নাড়িয়েছি। অনুরোধ করেছি। এখন হঠাৎ করেই, তারা আমার ভাইয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
অনুরোধ মতো শাকিল থানায় যান এবং ঘন্টা খানেক ধরে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেন। এরপর তাকে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তার সাথে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তার বাবার থেকে একটি বিবৃতিতে সাক্ষর নিয়ে দিতে বলা হয়।
শাকিল বলেন, ওই রাতে আমি পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে বাড়ি যাই এবং বাবাকে ঘুম থেকে জাগাই। কিন্তু বিবৃতি পড়ার পর আমার বাবা বিনীতভাবে সাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন। কারণ ওই বিবৃতিতে আমার ভাইয়ের সম্পর্কে ভুল তথ্য দে’য়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আমরা ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছি।
শাকিল জানান, ওই বিবৃতি ছিল মিথ্যা ও মনগড়া। আমার বাবা কোন তথ্য গোপন করেননি বা নিখোঁজ ডায়েরিতে কোন বিভ্রান্তকর তথ্যও দেননি। সত্য হল আট বছর আগে পুলিশ ডায়েরিতে এই তথ্য উল্লেখ করতে দেয়নি যে আমার ভাইকে অস্ত্রধারী পুলিশ গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।
শাকিলের বাবা সাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে, ওই পুলিশ কর্মকর্তা হুমকি দিতে শুরু করেন। ওই কর্মকর্তা একটা ফোন করেন। এরপর আধাঘন্টার মধ্যে সেখানে আরও সাত থেকে আটজন পুলিশ উপস্থিত হয়।
শাকিল বলেন, পুলিশেরা ভয় দেখাচ্ছিল। আমাদের বাসায় বাচ্চারা ছিল। তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যাই হোক, আমার বাবা সাক্ষর করেননি। এরপর বিএনপির এক প্রবীন নেতার হস্তক্ষেপের পর পুলিশ সেখান থেকে চলে যায়।
আর এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। গত দুই সপ্তাহে অন্তত ১০টি পরিবারকে এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের উপর পুলিশ চাপ প্রয়োগ করছে বিবৃতিতে সাক্ষর করাতে। ওই বিবৃতিতে সাক্ষর নিলে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাতিসংঘকে এটা প্রমাণ করতে পারবে যে, তাদের উপর আনা অভিযোগ মিথ্যা।
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গুম হওয়া তৎকালীন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমানে ২৫ নম্বর) বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলামের বোন তুলি জানান, গত সপ্তাহে তাঁদের বাড়িতে একাধিকবার পুলিশ এসেছিল।
মায়ের ডাকের সংগঠক আফরোজা ইসলাম আঁখি অভিযোগ করে বলেন, “পুলিশ সদস্যরা নানাভাবে ভীতি প্রদর্শন করে অনেকের কাছ থেকে লিখিত বিবৃতি আদায় করে নিয়েছে। ঢাকার বাইরে নোয়াখালীতেও তিনজন ভুক্তভোগী পুলিশের বয়ান অনুযায়ী বক্তব্য লিখে দিতে বাধ্য হয়েছেন।”
বাউনিয়া বাঁধ এলাকা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া পল্লবী থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক তরিকুল ইসলাম তারার পরিবারকেও হয়রানি করেছে পুলিশ।
তরিকুলের স্ত্রী বেবি আক্তারের বরাত দিয়ে মায়ের ডাকের আঁখি বলেন, “সোমবার তাকে ও তার বাবাকে ডেকে নিয়ে রাতের বেলা দুই ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখা হয়। পরে বৃহস্পতিবার তরিকুল গুম হওয়ার পর করা জিডিসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপি বাসায় গিয়ে নিয়ে এসেছে তারা।”
এদিকে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগগুলো বিবেচনায় নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)।
এক বিবৃতিতে এইচআরএফবি বলে, পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দুর্দশা আরও বাড়াচ্ছে।
বিবৃতিতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের প্রতি পুলিশের এমন আচরণ বন্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়ার দাবি জানায় এইচআরএফবি। একই সঙ্গে হয়রানির ঘটনায় যাঁরা জড়িত ও নির্দেশদাতা, তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এ ছাড়া গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজন ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার বিষয়েও তারা জানায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ