এই সুড়ঙ্গের ঠিকানা প্যারিস। ঠিকানাটা শুনলে খানিকটা চমকে গেলেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিশ্বের অন্যতম সুন্দর মহানগরী তথা আইফেল টাওয়ারের দেশেই রয়েছে এমনই এক ভয়ঙ্কর গণ-সমাধিক্ষেত্র। যা বিস্তৃত গোটা শহরজুড়েই। তবে বাইরে থেকে দেখা যাবে না।
এই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে ঢুকে পড়তে হবে প্যারিসের পেটের ভিতর। ভূগর্ভে। কিন্তু মাটির তলায় এমন সুড়ঙ্গ খনন করে সমাধিক্ষেত্র তৈরির কারণ কী? সেই গল্প জানতে ফিরে যেতে হবে কয়েক শতক। এই গণকবরের জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে। যদিও এই সুড়ঙ্গ নির্মিত হয়েছিল তারও প্রায় পাঁচশো বছর আগে।
ত্রয়োদশ শতকেই বিশ্বের অন্যতম জনপদ হয়ে উঠে ফ্রান্সের প্যারিস নগরী। শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আধুনিক সভ্যতা। আর তার অন্যতম কারণ ছিল, প্যারিসের নিচে জমে থাকা প্রাকৃতিক খনিজের ভাণ্ডার।
সেই খনিজ উত্তোলনের জন্যই খোঁড়া হয়েছিল এইসব সুড়ঙ্গ। তবে উত্তরোত্তর খনিজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায়, তিনশো বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় প্যারিসের খনিজ ভাণ্ডার। পরিত্যক্ত হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গগুলি।
এবার শ’খানেক বছর এগিয়ে চলে আসা যাক সপ্তদশ শতকে। সেসময় থেকে এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয় প্যারিস নগরী। প্যারিসের জনসংখ্যা কম ছিল না কোনোকালেই।
তার ওপর প্যারিস শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠায়, সেসময় গোটা ইউরোপ থেকেই কাজের আশায় প্যারিসে ভিড় জমাতেন মানুষ। ফলে দ্রুত গতিতে বাড়ছিল নাগরিকদের সংখ্যা। স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। আর তাতেই উপচে ওঠে শহরের সমাধিক্ষেত্রগুলি।
অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, তৎকালীন প্যারিসের সর্ববৃহৎ সমাধিক্ষেত্র লা ইনোসেন্ট গির্জার সেমেটারিতে গণসমাধির ব্যবস্থা করা হয়। এক-একটি গর্ত খুঁড়ে তাতে সমাধিস্থ করা হত প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। তবে সেই ‘সুবিধা’ পেতেও গুনতে হত মোটা অঙ্কের টাকা।
আর যে-সকল পরিবারের সামর্থ্য নেই, খোলা আকাশের নিচে স্তূপাকারে জমে থাকত তাঁদের প্রিয়জনদের মৃতদেহ। গির্জার কয়েক মাইল দূর থেকেও টের পাওয়া যেত মানবদেহ পচনের সেই দুর্গন্ধ। বিষয়টিতে প্যারিস প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে চাইলেও, লাভের কারণে সায় দেয়নি গির্জা কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে ঘটে যায় আরও একটা ভয়াবহ ঘটনা। ১৭৮০ সালে ভয়াবহ বৃষ্টি ও বন্যায় ভেঙে পড়ে লা ইনোসেন্ট সেমেটারির প্রাচীর। বন্যার জলে ভেসে পচা-গলা মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। শহরের হাল ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন রাজা ষোড়শ লুইস। সিদ্ধান্ত নেন লা ইনোসেন্টের সমাধিস্থল খুঁড়ে সমস্ত মানুষের দেহাবশেষই বার করে আনা হবে। আর তাদের নতুন ঠিকানা হবে প্যারিস শহরের সেই পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গে।
তবে খুব কিছু সহজ ছিল না সেই কাজ। হাজার হাজার শ্রমিকের দীর্ঘ ১২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর প্যারিসে সমাধিস্থ সমস্ত মানুষের দেহাবশেষই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুড়ঙ্গে। প্যারিসের পর পার্শ্ববর্তী শহর থেকেও সমাধিস্থ মানুষেরদের দেহ তুলে আনা হয় প্যারিসের সুড়ঙ্গে।
১৮১৪ পর্যন্ত চলে সেই কর্মযজ্ঞ। সবমিলিয়ে আনুমানিক ৬০-৭০ লক্ষ মানুষের দেহাবশেষ লুকিয়ে রয়েছে এই সুড়ঙ্গে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ২০ মিটার নিচে শায়িত এই সুড়ঙ্গের জন্য ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে প্যারিস।
১৮০৯ সালে প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেওয়া হয় সুড়ঙ্গের একটি বিশেষ অংশ। সেই অংশটি নিপুণভাবে সাজানো হয়েছিল মানুষের অস্থি দিয়েই। ২০০২ সালে ‘ক্যাটাকম্ব’ খ্যাত এই সুড়ঙ্গটিকে জুড়ে দেওয়া হয় প্যারিসের খ্যাতনামা কার্নাভালেট জাদুঘরের সঙ্গে।
টিকিট কেটেই ঘুরে আসা যায় এই মৃত্যুপুরীতে। তবে দুর্নামও খুব একটা কম নয়। এই ‘হাড়ের সুড়ঙ্গ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাড় হিম করা ভয়ঙ্কর সব ভূতুড়ে ঘটনার কাহিনিও।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ