অতিমারির ফলে প্রায় প্রতিটি দেশে লকডাউন হয়েছে। অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়েছে। প্রচুর মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। বহু মানুষ গরিব হয়েছেন। গরিব আরও গরিব হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের গবেষণা বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারিতে এশিয়ার ১৪০ মিলিয়ন বা ১৪ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়ে দারিদ্র্যের মুখোমুখি হলেও, ২০ জন নতুন বিলিয়নিয়ার তৈরি হয়েছে। খবর দ্যা গার্ডিয়ান
সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি মোকাবেলায় ফার্মাসিউটিক্যালস ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রির মাধ্যমে ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ এশিয়া অঞ্চলে নতুন বিলিয়নিয়ার হয়েছেন ২০ জন। অথচ অন্যদিকে, লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্থবিরতায় নতুন করে দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ।
চীন, হংকং, ভারত ও জাপানের নতুন এই বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে রয়েছেন ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (পিপিই) উৎপাদনকারী উইনার মেডিকেলের মালিক লি জিয়ানকুয়ান। আরও আছেন চীনের সানসুর বায়োটেকের মালিক ডাই লিঝং। সানসুর বায়োটেক কোভিড-১৯ শনাক্তের ডায়াগনস্টিক কিট উৎপাদন করে থাকে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে গেল বছর নভেম্বর পর্যন্ত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ধনীদের সংখ্যা ৮০৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ১,০৮৭। অর্থাৎ, দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ধনীদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। আর গড় হিসেবে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ বা তিন-চর্তুথাংশ।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এ অঞ্চলের ১ শতাংশ ধনী ব্যক্তি, সবচেয়ে দরিদ্র ৯০ শতাংশ ব্যক্তির মোট সম্পদের চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, ২০২০ সালে আনুমানিক ৮১ মিলিয়ন চাকরি হারিয়ে গেছে এবং কর্ম ঘণ্টা হ্রাস আরও ২২ থেকে ২৫ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অন্যদিকে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ১.৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা এ অঞ্চলে চাকরি হারানো প্রত্যেককে ১০ হাজার ডলার বেতন দিতে যথেষ্ট।
কোভিড আক্রন্ত হয়ে শুধু এশিয়াতেই মৃত্যু হয়েছে ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখের বেশি মানুষের। সংস্থাটি বলছে, মৃত্যু ও দারিদ্র্যের এই সংখ্যা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারি পরিস্থিতিতে নারীকর্মীদের চাকরি হারানো বা আয় বন্ধের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ধনী-গরিবের এই ব্যবধান আরও বাড়তে চলেছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। ক্রেডিট সুইসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও ৪২ হাজার ব্যক্তি নতুন করে অন্তত ৫০ মিলিয়ন ডলারের মালিক হবেন এবং আরও ৯৯ হাজার ব্যক্তি হবেন বিলিয়নিয়ার। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫.৩ মিলিয়নে, যা ২০২০ সালের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেশি।
এছাড়া বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয়ই জানিয়েছে, করোনভাইরাস মহামারি বিশ্বব্যাপী এই অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে গেল বছর নভেম্বর পর্যন্ত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ধনীদের সংখ্যা ৮০৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ১,০৮৭। অর্থাৎ, দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ধনীদের সংখ্যা প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেড়েছে। আর গড় হিসেবে তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ বা তিন-চর্তুথাংশ।
সমাজবিজ্ঞানীদের একটি নেটওয়ার্কের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়েলিটি রিপোর্ট বা বিশ্ব বৈষম্য প্রতিবেদনে (ডব্লিউআইআর) বলা হয়েছে, করোনা মহামারিকালে বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদ রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। চলতি বছর বৈশ্বিক বিলিয়নিয়ার তথা অতিধনীদের পারিবারিক সম্পদের সম্মিলিত পরিমাণ বেড়ে বৈশ্বিক সম্পদের ৩ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২০ সালের প্রথম দিকে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে ছিল ২ শতাংশের সামান্য বেশি।
সমীক্ষা অনুযায়ী করোনা মহামারিকালে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য, সামাজিক, লৈঙ্গিক (নারী-পুরুষ) এবং জাতিগত বৈষম্যও বাড়িয়ে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের তৈরি বিশ্বের বার্ষিক বিলিয়নিয়ার বা অতিধনী তালিকায় এই বছর রেকর্ডসংখ্যক ২ হাজার ৭৫৫ জন বিলিয়নিয়ারের নাম উঠে এসেছে, যাদের সম্পদের সম্মিলিত মূল্য ১৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে তাদের সমন্বিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ ট্রিলিয়ন বা ৮ লাখ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
প্রসঙ্গত, ১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন হয়, আর যাদের সম্পদের মূল্য ১০০ কোটি মার্কিন ডলার বা এর চেয়ে বেশি হয়, তাদের বিলিয়নিয়ার বা অতিধনী বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ট্রিলিয়ন হলো ১ লাখ কোটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট সম্পদের ১১ শতাংশ রয়েছে মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার ধনী লোকের কাছে, যা গত বছরে ছিল ১০ শতাংশ। অথচ এই মানুষগুলো বৈশ্বিক জনসংখ্যার মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ (০.০১%)।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বিধিনিষেধ চলাকালে বিশ্ব অর্থনীতিতে অতিধনীদের সম্পদ ফুলে–ফেঁপে উঠেছে, বিশেষ করে যারা অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের গতি জোরদার হওয়ার সুবাদে আর্থিক বাজারগুলোয় চাঙাভাব দেখা দেওয়ার কারণে অন্যদের সম্পদ বেড়েছে।
গত জুলাই মাসে বিশ্বে ধনী-গরীবের বৈষম্য নিয়ে বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, করোনাকালেও অতিধনীদের সংখ্যা কমা দূরে থাক, বরং বেড়েছে। আরো ছয় হাজার মানুষ অতি-ধনী হয়েছেন। নতুন ধনীদের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি আমেরিকায়। তারপর চীন এবং তিন নম্বরে জার্মানি।
মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মধ্যে খাদ্য প্রথম। সেই খাদ্যের জোগানের একমাত্র মাধ্যম কৃষি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা অধ্যুষিত বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখনো খাদ্যের অভাবে ধুঁকে মরছে। করোনা মহামারি যেন জ্বলে আসা আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে। এতে নতুন দরিদ্র হয়েছে আরও অনেকে। তবে একদিকে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ও খাদ্য সংকট বাড়লেও অন্যদিকে বিশ্বে বাড়ছে অতিধনীদের সংখ্যা। অল্প কিছু অতিধনী সাহায্য করলে বিশ্বের চলমান খাদ্যসংকট মেটানো সম্ভব বলে দাবি করেছেন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেছেন, এসব ধনকুবের যদি তাদের সম্পদের সামান্য অংশ দান করেন, তাহলে বিশ্বের বহু মানুষের মুখে দুমুঠো খাবার জুটবে। চাইলে অতিধনীদের কোনো একজনের একবারের দানেই বিশ্বজুড়ে অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা এসব মানুষ প্রাণে বাঁচবে।
ডেভিড বিসলি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে। তাদের সাহায্যে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। আমরা যদি সাহায্য নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে যেকোনো সময় তারা মারা যেতে পারে।’ তাদের সাহায্যে এখনই ধনকুবেরদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
করোনাকালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চলছে অর্থনৈতিক সংকট৷ স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তাও পড়েছে সংকটে৷ বাড়ছে ক্ষুধার্তের সংখ্যা৷
২০২০ সালে প্রতি দশজনে একজন মানুষ অন্তত পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য পায়নি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সাব সাহারান আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে পানির সংকট রয়েছে, কিংবা যেসব জায়গায় আঞ্চলিক সংঘাত চলছে, সেসব জায়গার মানুষ খাদ্যসংকটে বেশি ভুগেছে৷
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে একাধিক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। গত কয়েক দশকে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাষযোগ্য জমি সংরক্ষণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম বনায়ন, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যস্ত হয়ে আছে বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮০৩
আপনার মতামত জানানঃ