একবার এক নাজি সেনা অফিসার পাবলো পিকাসোর আঁকা ‘গুয়ের্নিকা’ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কে করেছে? পিকাসো ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন, তোমরা করেছ। ঠিক এমনটাই ঘটেছে টিএসসির কাওয়ালির আসরে। কারণ সংস্কৃতি আক্রান্ত হলে তার শক্তি আরও বেড়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) অনুষ্ঠিত কাওয়ালি গানের আসরে ভাঙচুর করেছে একদল দুর্বৃত্ত। বুধবার (১২ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৬টার দিকে আসর শুরু হওয়ার পরপরই দুর্বৃত্তরা মঞ্চে উঠে আয়োজক এবং দর্শকদের মারধর করে।
এই ঘটনার পরে বিভিন্ন জেলায় কাওয়ালির আসরের ঘোষণা আসছে। আজ আবার টিএসসিতে হবে প্রতিবাদী কাওয়ালির জমায়েত। বিষয়টা আর গানে আটকে নেই, কাওয়ালি হয়ে উঠেছে জুলুমের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ। কে তা করে তুলল? পিকাসোর মতো করে উত্তর আসবে, ‘তোমরা করে দিয়েছ’।
যা ঘটেছিল
প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজ শাখার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। এ ঘটনায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হলে সাড়ে ৬টার দিকে একদল লোক এসে লাঠিসোটা নিয়ে অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। হামলাকারীরা অনুষ্ঠানের চেয়ার ভাংচুর করে। একপর্যায়ে মঞ্চ গুঁড়িয়ে দেয়। পরে কাওয়ালি শুনতে আসা শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে স্থান ত্যাগ করেন।
ঢাবির ৩য় বর্ষের ছাত্র রাফিজ খান বলেন, ‘প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই একদল লোক জোর করে মঞ্চে উঠে পড়ে এবং ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্র ও দর্শকদের মারধর শুরু করে।’
পরে তারা উপস্থিত লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে। অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক মীর হুজাইফা আল মামদূহ বলেন, ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন কোভিডের জন্য অনুষ্ঠান বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন।
ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য আয়োজকদের আগেই অনুষ্ঠান স্থগিত করতে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি (আক্রমণ) অপ্রত্যাশিত। হামলার পেছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করতে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব।’
এদিকে হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ইসলামী শরিয়া নিয়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে তাদের (আয়োজকদের) নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে এই হামলা করা হয়।’
ফ্যাসিস্টদের মৌলবাদী টোপ
তালেবান গানকে ভয় পায়, পাকিস্তানে হত্যা করা হয়েছে খ্যাতনামা এক কাওয়ালিশিল্পীকে। আর বাংলাদেশে শিল্পীদের টুঁটি চিপে গানের জলসা তছনছ করল।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক অনুষ্ঠান আয়োজনের পেছনে মৌলবাদীদের হাত দেখতে পাচ্ছেন। একটি টিভির অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি মৌলবাদী সংগঠন ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছিল কিনা বা জঙ্গিবাদে জড়িত ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা এখানে জড়িত ছিল কিনা ইত্যাদি। অথচ যত ফায়দা গানের জলসাটি সরবরাহ করতে পারত, হামলা চালিয়ে তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
কিন্তু মানুষ দেখল, মৌলবাদীরা যা করতে চায়, তা করে দিল প্রগতিবাদের দাবিদারেরা। এই প্রগতির নামধারী সংগঠনের মাইক থেকে জাতীয় দিবসে দেদার নিম্ন রুচির হিন্দি গান বাজে। সেসব শুনে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কথা ভেবে মাথা হেঁট হয়ে আসে।
কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়াতে গেলে তাকে ইসলামি বলা কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বলারও দরকার নাই। টিএসসিতে মান্দি-গারো-চাকমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, সেগুলি কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ? সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা থাকবে, সেসব মিলিয়েই বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি।
এ দেশের জনসংস্কৃতিতে উদার মানবতাবাদী ভাব অজস্র ধারায় বয়ে চলেছে। কাওয়ালিও চাপা পড়া মানবতাবাদের কথা বলে। এটা উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষের আধ্যাত্মিক আকুতির গান। কাওয়ালির পক্ষে দাঁড়াতে গেলে তাকে ইসলামি বলা কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ বলারও দরকার নাই।
সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা থাকবে, সেসব মিলিয়েই বাংলাদেশ ও তার সংস্কৃতি। এই দেশ কখনো একজাতীয় বা এক ধর্মীয় ছিল না। তাই যদি ধরেও নিই, কাওয়ালি বাঙালি নয়, তাতে অসুবিধা কী? সংস্কৃতিকে জাতীয়তাবাদী খোপে আটকে রাখার চিন্তাটাই ফ্যাসিবাদী।
হামলার প্রকৃত কারণ
ওরা আসলে ভয় পেয়েছে এমন এক জমায়েতকে, যারা সন্ত্রাসী শক্তির নিষেধ উপেক্ষা করে জড়ো হয়েছিল। তরুণদের জমায়েতকে তারা তো ভয় পাবেই, যারা জানে যে তারা জনপ্রিয় নয়, ন্যায়ের পক্ষেও নয়।
যদি ছাত্রলীগ কনসার্ট করতে পারে, তাহলে অন্যেরা কাওয়ালির জলসা করতে পারবে না কেন? পারবে না, কারণ কাওয়ালির জলসা আয়োজকদের হাতে ক্ষমতাসীনদের অনুগ্রহসূচক কোনো সনদ ছিল না।
তাদের ছাড়া আর কারও জমায়েত তারা হতে দেবে না। কিন্তু কেন দেবে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি গোষ্ঠীর জমিদারি আঙিনা? প্রশাসন ও প্রক্টররা কী করেছেন? কর্তৃপক্ষ দায়ী নয় বললে হবে না, দায়িত্বে যেহেতু রয়েছেন, সেহেতু এই সন্ত্রাসের দায় আপনাদের ওপরও বর্তাবে।
টিএসসিতে রয়েছে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য, রয়েছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শহীদ ডা. মিলনের স্মৃতিমঞ্চ, রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য, অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অপরাজেয় বাংলা।
অথচ এই টিএসসিতে নিয়মিতভাবে নারী নির্যাতন হয়, ছাত্রছাত্রীদের ওপর সন্ত্রাস চালানো হয়, ছিনতাই হয়। অথচ এদিকে উপাচার্যের বাড়ি, ওদিকে শাহবাগ থানা। টিএসসিকে আর কত লাঞ্ছিত করা হবে? শুধু টিএসসি নয়, ঢাকা কার শহর, কার রাজধানী, সেই প্রশ্নও মনে জাগছে।
কাওয়ালির ঐতিহ্য
কাওয়ালির ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। অথচ তাকে ঠেলে পুরান ঢাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই পুরান ঢাকার পিয়ারু সরদার ভাষা আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ঢাকা ছিল গানের আর বাগানের শহর। সেই শহরে শাহবাগ, পরীবাগ, সেগুনবাগিচা, সবুজবাগ, আরামবাগ, লালবাগ, গোপীবাগ, রাজারবাগ, মালিবাগ, সোবহানবাগ—এসব ছিল।
চল্লিশের দশকেও গানে ভরপুর ছিল ঢাকা। দীপেন্দ্রেনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পাচ্ছি, বুদ্ধদেব বসুর লেখায় পাচ্ছি। বাগিচা থাকলে গানও থাকবে। চল্লিশের দশকের ঢাকা ছিল বাগান আর হারমোনিয়ামের শহর। সেখানে, টিএসসিতে গানের জলসায় হামলা করে বোঝানো হয়েছে, ঢাকার পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরতে দেওয়া হবে না!
পুরান ঢাকায় ঢুকিয়ে দেওয়া কাওয়ালিকে সংস্কৃতির মূল মঞ্চে আসতে হলে বাধা তো আসবেই। ভাষা আন্দোলনে শামিল কুট্টিরা কাওয়ালি ভালোবাসে। এই হামলা তাদের ওপরও বর্তায়। ঢাকায় ভাটিয়ালিও নেই, ভাওয়াইয়া নেই, জারি-সারি নেই, যাত্রাগান, মাইজভান্ডারি নেই। খালি মাইক ফাটানো চিৎকার আর আতশবাজির হিন্দি-লেডি গাগা এখানে চলবে। আর কিচ্ছু না।
সংগীতজ্ঞ সাইম রানা বলেছেন, কাওয়ালিসংগীত পুরান ঢাকার একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। মধ্যযুগে এই সংগীতের মাধ্যমে উত্তর ভারতীয় সংগীতের এক মহাজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে খেয়ালের যে সাংগীতিক বিস্তার, এর সঙ্গে কাওয়ালির সম্বন্ধ নিবিড়।
এর সূচনা হয়েছিল তুর্কি চারণ কবিদের মাধ্যমে। ভারতে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, ওস্তাদ আমির খসরু, সেলিম চিশতি, বদরুদ্দিন রিয়াজ, শাহনেওয়াজ প্রমুখ কাওয়ালিসংগীতের বিকাশ ঘটান। বর্তমানকালের নুসরাত ফতে আলী খান, আবিদা পারভিন, বাংলাদেশের রুনা লায়লার নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এই ঐতিহ্যের ওপর আঘাত হেনে নিষিদ্ধবাদীদের আরও মদদ দেওয়া হলো। অথচ ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভালো করে, তবুও মনে হতো আরও শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, আমরা যাকে ‘কাওয়ালি’ বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৫৬)
এসডব্লিউ/এসএস/১৭১০
আপনার মতামত জানানঃ