বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ টিকাদানে গতি আসায় মহামারীর ধকল কাটিয়ে বছরের শুরু থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। ধীরে হলেও বাড়ছিল আমদানি-রপ্তানি, চাঙ্গাভাব বিরাজ করছিল শেয়ারবাজারগুলোয়, মূল্যস্ফীতি ছিল নিয়ন্ত্রণে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছিল, গত বছর বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধির হার ভালোই হবে। কিন্তু বছরের মাঝামাঝি থেকে সরবরাহ সংকট শুরু হয়। প্রথমে ধারণা ছিল, এতে হয়তো বিলাসবহুল গাড়ির সংকট হবে বা বড়জোর বড়দিনের সময় ক্রিসমাস ট্রি সাঁজানোর উপকরণে টান পড়বে। কিন্তু হঠাৎ বাধ সাধল করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। অতিসংক্রামক এ ধরনের বিস্তারে এরই মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। ২০২০-২০২১ সালজুড়েই ছিল করোনার প্রকোপ। দেশে দেশে টানা লকডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় স্থবির হয় আর্থিকখাত। তৈরি হয় অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। এর তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এমনকি উন্নত সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতিতেও পড়ে প্রভাব। যে সব দেশের অর্থনীতি পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য নতুন শঙ্কা হিসেবে দেখা দিয়েছে ওমিক্রন। আর তাই বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য নতুন সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। খবর এএফপি
বৈশ্বিক অর্থনীতির অন্যতম শীর্ষ এই সংস্থাটি জানিয়েছে, ভাইরাসের অতিসংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে সারা বিশ্বে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে সম্ভাব্য কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বৃদ্ধির প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়ে যাচ্ছে।
আগামী ২৫ জনুয়ারি বৈশ্বিক অর্থনীতির বিষয়ে হালনাগাদ রিপোর্ট প্রকাশ করবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এর আগে সোমবার সংস্থাটি জানিয়েছে, মহামারির কারণে ক্ষতির শিকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কার্যক্রম চলতি বছর এবং আগামী বছরও অব্যাহত থাকবে।
গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিশ্বব্যাপী দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোতে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ প্রতিদিনই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এটিই সারা বিশ্বে নতুন করে স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করেছে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ডেল্টা বা আরও অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ওমিক্রন গুরুতর অসুস্থতা সৃষ্টি করে না। তবে অতিসংক্রামক এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে বহু মানুষ সংক্রমিত হয়ে পড়ায় বহু দেশ ফের লকডাউনসহ বিধিনিষেধ আরোপ করছে। আর এটিই বৈশ্বিক আর্থিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায়।
আইএমএফের অর্থনীতিবিদ স্টেফান ড্যানিঞ্জার, কেনেথ ক্যাঙ এবং হেলেন পোইরসন একটি ব্লগ পোস্টে লিখেছেন, করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে সম্ভাব্য কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কারণ করোনা মহামারির কারণে এসব দেশে মুদ্রাস্ফীতি এবং উল্লেখযোগ্যভাবে সরকারি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভাইরাসের অতিসংক্রামক ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে সারা বিশ্বে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে সম্ভাব্য কঠিন সময়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বৃদ্ধির প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ শিগগিরই সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশটি। মুদ্রাস্ফীতির কারণে উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে দৈনন্দিন খরচ অনেক বেড়েছে।
আর সুদের হার আরও বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে, উদীয়মান অনেক দেশের ডলার-নিয়ন্ত্রিত ঋণের খরচও অনেক বেড়ে যাবে। এসব দেশ ইতোমধ্যেই মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে পিছিয়ে রয়েছে এবং শিগগিরই আরও অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা দেশগুলো খুব কমই বহন করতে সক্ষম। আর এই পরিস্থিতিতে, নিজেদের সক্ষমতা ও দুর্বলতার ওপর ভিত্তি করে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে বলে মনে করে আইএমএফ।
এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন, আগামী মাসগুলোতে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিফলন পাওয়া যেতে পারে। এমনিতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে টানা কয়েক মাস ধরে। ফলে সংকটে পড়েছেন মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষ। তবে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলো এখন পর্যন্ত ইতিবাচক রয়েছে। আশানুরূপ রপ্তানি আদেশ পাচ্ছে পোশাক খাত। শিল্প উৎপাদনে বেড়েছে গতি। নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে রিজার্ভে। কৃষি খাত তো বন্ধ হয়নি কখনই। সব মিলিয়ে কোভিড-১৯ বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথেই ছিল। কিন্তু ওমিক্রনের আগমনে আবার সব কিছু হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, মহামারীর প্রথম লকডাউনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি। করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের প্রণোদনা টাকা ফেরত দেওয়া শুরু হয়েছে। যদিও এ টাকা পরিশোধ করা কঠিন। কিন্তু ব্যাংক চাপ দিয়ে টাকা কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রপ্তানি করে মুনাফা করা কঠিন। এ জন্য প্রণোদনার টাকা ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্র দীর্ঘমেয়াদি হওয়া উচিত। ইউরোপের দেশগুলোয় ফের লকডাউন দেওয়া হলে সেই ধাক্কা মোকাবিলা আমাদের জন্য কঠিন হবে। এর আগে ইউরোপে লকডাউনের সময় রপ্তানি কমেছিল। লকডাউন খুলে দেওয়ার পর্যটকরা ভ্রমণ করতে শুরু করেছিল। ফলে নতুন করে রপ্তানি বাড়তে শুরু করে। আবারও লকডাউন দেওয়া হলে রপ্তানি বাজার ধরে রাখা কঠিন হবে।
রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, নতুন করে রপ্তানি বাজারে লকডাউন এলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি খাতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
বিশ্লেষকরা বলেন, সাধারণভাবে মনে করা হয়, কোনো সংকট দেখা দিলে সেই সংকটের যারা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে, তারাই পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক উত্তরণ সহজতর করতে পারে। এটি স্বীকৃত অর্থনৈতিক থিয়োরিও বটে। অর্থাৎ একই দুর্যোগ যখন কোনো অঞ্চল অথবা সারা বিশ্বকে সংক্রমিত করে, তখন যেসব দেশ সেই সংকট ব্যবস্থাপনায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে তারাই সফল হয়।
সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্য দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক শক্তিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতির সব থিয়োরি সব সময় একইভাবে প্রযোজ্য বা কার্যকর হয় না। এমন অনেক দেশ আছে যারা করোনা সংক্রমণ সঠিকভাবে মোকাবিলা না করেও তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ধরে রাখতে পারছে। আবার কোনো কোনো দেশ করোনা সংক্রমণ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ঠিক রাখতে পেরেছে।
তারা বলেন, করোনার সংক্রমণজনিত আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে আগামী দিনে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। যারা পেশাচ্যুত বা কর্মচ্যুত হয়েছেন, তাদের আগের কর্মে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তাহলেই আগামী দিনে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে। সাধারণত দুর্যোগের সময় অর্থনীতির বেশির ভাগ সেক্টরই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু করোনার প্রভাব আমাদের জনশক্তি রপ্তানি খাতের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৬
আপনার মতামত জানানঃ