যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নীতির মোকাবিলায় নানা প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইরান ও রাশিয়া তাদের লেনদেন থেকে ডলার বাদ দিয়েছে। ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে সব ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইরানের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের একপেশে নীতির কারণেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের আধিপত্য ক্ষুণ্ন করতে ভুক্তভোগী দেশগুলো চেষ্টা করে আসছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা দেশগুলো ডলারের আধিপত্যের কারণে এ পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক দেশই ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় অথবা অন্য কোনো দেশের মুদ্রা ব্যবহারে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ হাসিলের জন্যও ব্যবহার করছে, যা এখন সব দেশের কাছেই স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের এই আধিপত্যকামী নীতি ডলারের প্রতি বিভিন্ন দেশের আগ্রহকে তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জোরদারের বিষয়টি ডলার বাদ দেওয়ার আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছে। মার্কিন মুদ্রার কবল থেকে মুক্ত হতে নানা অর্থনৈতিক সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের কথা উল্লেখ করা যায়। মলদোভা ও কিউবা এরইমধ্যে সংস্থাটির পর্যবেক্ষক সদস্য হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির ওপর পাশ্চাত্যের একচ্ছত্র আধিপত্য মোকাবিলা করার লক্ষ্যে রাশিয়ার নেতৃত্বে যেসব অর্থনৈতিক সংস্থা গঠিত হয়েছে, এটি তার অন্যতম।
এছাড়া আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হলো সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা ও ব্রিকস। বিশ্ববাজারে মার্কিন ডলারের প্রভাব খর্ব করার লক্ষ্যে বর্তমানে একটি অভিন্ন মুদ্রা চালু করার বিষয়টি বিবেচনা করছে ব্রিকস। বর্তমানে রাশিয়া এবং চীন তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের প্রায় ৭০ শতাংশই সম্পন্ন করছে নিজ নিজ মুদ্রায়।
এছাড়া লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল এবং আফ্রিকা মহাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকাও ডলারের বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেনের পক্ষে। এসব দেশও ডলারমুক্ত বাণিজ্যিক লেনদেন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় এরইমধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারকে বাদ দিয়েছে রাশিয়া ও ইরান।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ডলারে রিজার্ভ রাখার প্রবণতা কমছে। ২০০৩ সালে যা ছিল ৬৬ শতাংশ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমে ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা এ বিষয়ে বলেছেন, ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়েছে। কারণ বিভিন্ন দেশ মার্কিন ডলারের ওপর তাদের অর্থনৈতিক নির্ভরতার ইতি টানতে চায়। বিভিন্ন দেশের ওপর আর্থিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মার্কিন নীতিই এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিংবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল হার্টনেট সম্প্রতি সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, ডলারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পরিণতি ভালো হবে না।
অন্যদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো বলেছেন, ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ধরে নিয়ে এর ওপর ইউরোপের নির্ভরশীল থাকা উচিত হবে না। কৌশলগত স্বাধীনতা না থাকলে ইউরোপ ইতিহাস থেকে মুছে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।
এদিকে ডলারের বিপরীতে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা হয়ে উঠেছে চীনের ইউয়ান। রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যের একটি বড় অংশই এখন ইউয়ানে সম্পন্ন হচ্ছে।
এ বিষয়ে রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিক জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন ৯২ শতাংশ বেড়েছে এবং এসব লেনদেনে রুশ মুদ্রা রুবল ও চীনা মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহৃত হচ্ছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালে দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ২৪ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লি টি ওয়ান বলেছেন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির সূচকগুলোর একটি হচ্ছে জাতীয় মুদ্রার ব্যবহার। জাতীয় মুদ্রা ব্যবহারে চীন অনেক বেশি অগ্রগামী এবং চীন বর্তমানে শতাধিক দেশের সঙ্গে জাতীয় মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়ে চুক্তি করেছে।
এদিকে ডলারের অবনমন ও মার্কিন আধিপত্য হারানোর বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক নিল ফার্গুসন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে নিজের কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে। যেমনিভাবে এক সময় স্পেন, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড তাদের আধিপত্য হারিয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ