ফেইক নিউজকে একটি মাত্র সংজ্ঞায় বাঁধা যাবে না। বিভিন্ন পরিস্থিতি একে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সামনে নিয়ে আসে। যা কিনা সমাজে মিডিয়ার প্রভাব ও ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ফেইক নিউজের প্রভাব বড় প্রসঙ্গে গণতন্ত্রকে সমস্যাগ্রস্ত করে। যেখানে অন্যরা নিউজ মিডিয়া সম্পর্কে উদাসীন থাকতেই পছন্দ করে যা কিনা তাদের মিডিয়া সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তারই ফলাফল।
তৃতীয় একটি পক্ষ এই চিন্তাগুলোকে জনসম্মুখে নিয়ে আসে, মিডিয়ার নিহিলিজমকে প্রমোট করে। তবে এই প্রমোশনাল কাজটা তারা তাদের ব্যক্তিগত ভয় ও ভ্রান্ত ধারণা থেকেই করে থাকে।
মিডিয়ার নিহিলিজম ফিকশন এবং ফ্যাক্টের মধ্যে মানুষের পার্থক্য করার সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে যে কোন ব্যবস্থার প্রতি মানুষ বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। যা কিনা সত্যের বাইরে এক রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়ার জন্ম দেয়।
কিন্তু ফ্যাক্ট সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তা মানুষের অনুভূতিতে আঘাত নাও করে, তবুও এটা গুরুত্বপূর্ণ।
ফেইক নিউজ কী?
ক্যামব্রিমজ ডিকশিনারি এবং ম্যাকমিলান ডিকশিনারির সংজ্ঞানুযায়ী, ফেইক নিউজ হলো বাস্তব ঘটনার আন্তর্জাতিক জালিয়াতি। এই জালিয়াতি সত্যের থেকেই জন্ম নেয় এবং খুব সহজেই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ফেইক নিউজ তৈরি যারা করছে, তারা বিজ্ঞাপন থেকে লাভের আশায় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করছে। মানুষের চিন্তায় প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখছে।
বিশ্বের ২৮টি দেশে ২০১৮ সালের এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের এক জরিপ চালানো হয়। যেখানে দেখা গেছে, সংবাদ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে যা দেখা যায়, সেসবের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকেন ৫৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে এই ফেক নিউজ বা ভুয়া খবরকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারে উদ্বিগ্ন প্রতি ১০ জনের সাতজন।
অ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটার নামের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৩ শতাংশই জানেন না, গুজব বা মিথ্যা খবর থেকে সৎ সাংবাদিকতাকে কীভাবে আলাদা করতে হয়! অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে সৎ সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট।
ডিসিএমএ-এর প্রতিবেদন
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবরের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে তা গণতন্ত্রের জন্য রীতিমতো হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ‘ডিজিটাল, কালচার, মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্টস’-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির (ডিসিএমএ) প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হয় ২০১৮ সালে।
দীর্ঘ ১৮ মাস তদন্ত শেষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ও ভীতিকে উসকে দিয়ে নির্বাচনে ভোট ভাগিয়ে নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে ‘ভুয়া খবর’ ছড়ানোর বিষয়টি গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। আর এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ফেসবুক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন তথ্যের জন্য গতানুগতিক মাধ্যম সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা রেডিওর বদলে ফেসবুক, টুইটারের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমের ওপর বেশি নির্ভরশীল।
মানুষ এসব মাধ্যমে দেখা খবরকে সহজে বিশ্বাস করে। কারণ নিজেদের পরিচিত বা জানাশোনা লোকজন এসব শেয়ার করে। অথচ এসব তথ্যের ওপর সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
দায়িত্ব কাদের?
ভুল তথ্য, মিথ্যা গল্প, ভ্রান্ত ধারণা, জালিয়াতির ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বটা মূলত সবার।
যদিও সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা আছে এক্ষেত্রে, তবে একচেটিয়া টেক কোম্পানিগুলোর প্রয়োজন ফেইক নিউজের ছড়িয়ে পড়া প্রতিহত করতে সামনে এগিয়ে আসা।
যেহেতু টেক জায়েন্ট হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে উত্থান ঘটছে। তাদের কর্মীদের সাধারণ মানুষের স্বার্থ অবহেলা করা সংক্রান্ত ঘটনাগুলোকে প্রকাশ্যে আনার জন্য, সোশ্যাল মিডিয়ার বহুমুখী প্রভাব স্বীকার করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। টেক কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য প্রফিট, যা কিনা ভুল তথ্য ও ফেইক নিউজ ছড়িয়ে পড়ার মুখে লাগাম টানতে বাধা দিচ্ছে।
একই সময়ে সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের উচিত মিডিয়াকে মূর্খদের থেকে আলাদা করতে চেষ্টা করা। সাংবাদিকদের স্বচ্ছ হওয়া উচিত এবং কন্টেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে আরও বেশি বাস্তবসম্মত হওয়া। এক কথায় তারা মানুষের সামনে ফেইক নিউজের বিরুদ্ধাচারণের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ