করোনায় সারাবিশ্বের মানুষ যখন ঘরবন্দী তখন ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে ডাক্তার, নার্সদের মতন ফ্রন্টলাইনে কাজ করছেন সাংবাদিকরা। মহামারির দুই বছরে বিশ্বের ৯৪ দেশে কমপক্ষে দুই হাজার সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে মারা গেছেন অন্তত এক হাজার ৪০০ জন। এ হিসাবে মাসে গড়ে ১১৬ জন ও দিনে প্রায় চারজন করে সাংবাদিক মারা গেছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের ৬৮ সংবাদকর্মীও।
জেনেভাভিত্তিক সংগঠন প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন (পিইসি) শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) এসব তথ্য জানিয়েছে।
করোনার প্রথম ধাক্কায় বহু চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী, পুলিশ মারা গিয়েছেন। তাই সামনের সারির এই যোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য টিকা আবিষ্কার হতেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা দেওয়া আরম্ভ হয়। ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই প্রথম সারির যোদ্ধাদের মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছে। কিন্তু আর এক শ্রেণির প্রথম সারির যোদ্ধাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। করোনাকালে প্রতিদিন রাস্তায় বেরিয়ে খবর সংগ্রহ করা সেই সাংবাদিকদের জন্য অনেক পরে টিকাকরণের ব্যবস্থা হয়েছে। টিকা নেওয়ার আগেই অনেক সাংবাদিক করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
করোনায় প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ প্রাণ কেড়েছে অসংখ্যা মানুষের। করোনার সংক্রমণ রুখতে লকডাউন, কারফিউ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু, তার মধ্যেও পেশার তাগিদে সাংবাদিকদের অফিস যেতে হয়েছে, মাঠে নেমে কাজ করতে হয়েছে।
পরিসংখ্যানটি বলছে, সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক মারা গেছেন লাতিন আমেরিকায়, ৯৫৫ জন। তাছাড়া এশিয়ায় ৫৫৬, ইউরোপে ২৬৩, আফ্রিকায় ৯৮ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে ৬৮ জন সংবাদকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন করোনায়।
পিইসি বলছে, মৃতদের এই তালিকার বাইরে আরও ৫০ জন রয়েছে। যারা ঠিক করোনায় মারা গেছেন কিনা তা এখনো যাচাইবাছাই চলছে। সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের বিশ্বাস, করোনায় মারা যাওয়া সাংবাদিকদের সংখ্যা অবশ্যই আরও বেশি হবে। কারণ সাংবাদিকদের মৃত্যুর কারণ কখনো কখনো নির্দিষ্ট করা হয় না বা তাদের মৃত্যুর বিষয় ঘোষণা (বৃহৎ পরিসরে) দেওয়া হয় না। কিছু কিছু দেশে, কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। পিইসির ভারতীয় প্রতিনিধি নাভা ঠাকুরিয়ার মতে, দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোয় করোনা মহামারিতে ৪০০ জনেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মী প্রাণ হারিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তির করোনাজনিত মৃত্যুর বিষয়টি এখনো প্রমাণিত হয়নি।
পিইসির মহাসচিব ব্লেইস লেম্পেন বলেছেন, ২০২১ সালের প্রথমার্ধে যে হারে করোনায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তা টিকা আসার পর বছরের দ্বিতীয়ার্ধে কমেছে। পিইসি বলছে, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে করোনায় ২২৫ জন সাংবাদিকের মৃত্যুর তথ্য তারা নথিভুক্ত করে। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ২৫ জন, নভেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ২৭, সেপ্টেম্বরে ৩৩, আগস্টে ৪২ ও জুলাইয়ে ৭০ জন মারা যান। অথচ ২০২১ সালের প্রথমার্ধে এক হাজার ১৭৫ জন সাংবাদিক কোভিড-১৯ এ মারা যান।
মহামারির দুই বছরে বিশ্বের ৯৪ দেশে কমপক্ষে দুই হাজার সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে মারা গেছেন অন্তত এক হাজার ৪০০ জন। এ হিসাবে মাসে গড়ে ১১৬ জন ও দিনে প্রায় চারজন করে সাংবাদিক মারা গেছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের ৬৮ সংবাদকর্মীও।
পিইসি আশা করছে গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মতো করোনায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর নিম্নমুখী হার চলতি বছরেও অব্যাহত থাকবে। যদিও তারা করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। সংগঠনটি সব গণমাধ্যমকর্মীকে করোনার বুস্টার টিকা গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক মারা গেছেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। সেখানে ২৯৫ জন গণমাধ্যমকর্মী মারা যান। ভারতে এ সংখ্যা কমপক্ষে ২৭৯ জন। এ ছাড়া পেরুতে ১৯৯, মেক্সিকোতে ১২২, কলম্বিয়ায় ৭৯ ও বাংলাদেশে ৬৮ জন সাংবাদিক মারা যান।
পিইসি জানিয়েছে এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ৬৬, ইতালিতে ৬১, ভেনেজুয়েলায় ৫৯, ইকুয়েডরে ৫১, আর্জেন্টিনায় ৪৭, ইন্দোনেশিয়ায় ৪২, রাশিয়ায় ৪২, ইরানে ৩৪, যুক্তরাজ্যে ৩৩, তুরস্কে ২৯, ডোমিনিকান রিপাবলিকে ২৯, পাকিস্তানে ২৭, নেপালে ২৩, মিশরে ২২, বলিভিয়ায় ২০, হন্ডুরাসে ১৯, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯, স্পেনে ১৯ ও ইউক্রেনে ১৯ জন সাংবাদিক করোনায় মারা যান।
করোনায় পানামায় ১৭, পোল্যান্ডে ১৪, ফ্রান্সে ১১, গুয়াতেমালায় ১১, নাইজেরিয়ায় ১১, আফগানিস্তানে ১০, নিকারাগুয়ায় ১০, জিম্বাবুয়ে ১০, আলজেরিয়ায় ৯, কিউবা ৯, প্যারাগুয়ে ৮, ফিলিপাইনে ৭, উরুগুয়ে ৭, কাজাখস্তান ৫, রোমান ৫, কেনিয়ায় ৫, মরক্কোয় ৪, ক্যামেরুনে ৪ ও ইরাকে ৪ জন মারা যান। করোনাভাইরাসে আলবেনিয়া, আজারবাইজান, কোস্টারিকা, পর্তুগাল, সালভাদর ও সুইডেনে অন্তত ৩ জন করে সাংবাদিক মারা গেছেন।
পিইসি করোনায় দুজন করে সাংবাদিক মারা যাওয়ার তথ্য পেয়েছে অস্ট্রিয়া, বেলারুশ, বেলজিয়াম, বেনিন, বুলগেরিয়া, কানাডা, চিলি, জার্মানি, ঘানা, গ্রিস, গায়ানা, শ্রীলঙ্কা, সুইজারল্যান্ড ও উগান্ডায়।
আরও ৩০ দেশে অন্তত একজন করে সাংবাদিক করোনায় মারা গেছে বলে পিইসি নিশ্চিত হতে পেরেছে। দেশগুলো হলো, অ্যাঙ্গোলা, বার্বাডোজ, বসনিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইসরায়েল, জ্যামাইকা, জাপান, জর্ডান, কিরগিজস্তান, কসোভো, লেবানন, লিথুনিয়া, মালয়েশিয়া, মালাউই, মালি, মালদোভা, মোজাম্বিক, মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, টোগো, তাজিকিস্তান, তিউনিসিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হয় প্রাণঘাতী সার্স-কোভ-২ ভাইরাস, যা বিশ্বে সাধারণভাবে পরিচিতি পায় করোনাভাইরাস নামে। শনাক্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাসটি। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ যদিও অভিযোগ করে আসছে, চীনের গবেষণাগারে এই ভাইরাসটি কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, তবে চীন বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, প্রাকৃতিকভাবেই আবির্ভাব ঘটেছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করে। ২০২০ সালের প্রথম সাত-আট মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক আক্রান্ত ও মৃত্যুর পর ওই বছরের শেষ দিকে কিছুটা কমে এসেছিল করোনা সংক্রমণ। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির করোনা প্রতিরোধী টিকা বাজারে এসে যাওয়ায় গণটিকাদান কর্মসূচিও শুরু করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।তবে গত মার্চ থেকে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ফের ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করেছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে করোনার তৃতীয় ঢেউ পার করছে দক্ষিণ এশিয়া।
করোনাভাইরাসের সবচেয়ে সংক্রামক ধরনের স্বীকৃতি পাওয়া ওমিক্রনের প্রভাবে বিশ্বে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়েছে। তারমধ্যে শুক্রবার বিশ্বজুড়ে করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ২৬ লাখ ৮৯ হাজার ৯৬৬ জন।
এছাড়া, ২০২০ সালে মহামারি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাণঘাতী এই রোগে বিশ্বজুড়ে মৃত্যু হয়েছে মোট ৫৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৯১ জনের। তার মধ্যে শুক্রবার মারা গেছেন ৬ হাজার ৩৬৫ জন।
বিশ্বজুড়ে সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ২৩ হাজার ৩৫৬ জন। এই রোগীদের মধ্যে কোভিডের মৃদু উপসর্গ বহন করছেন ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার ২২৮ জন এবং গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন ৯৩ হাজার ১২৮ জন।
এছাড়া, শুক্রবার করোনা থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১০৩ জন। এই নিয়ে মহামারির দুই বছরে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ওঠা মোট ব্যক্তির সংখ্যা পৌঁছেছে ২৫ কোটি ৮২ লাখ ১৫ হাজার ৩২৬ জনে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৮
আপনার মতামত জানানঃ