বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির প্রভাব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ভারতে বেকার হয়ে পড়েছে লাখ লাখ যুবক। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশেরও বেশি, যা গত চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএমআইই’র এক পরিসংখ্যান থেকে এই তথ্য জানা গেছে। খবর বিবিসি নিউজ।
ভারতের বেকারত্ব ও চাকরি সংকটের কিছু চিত্র তুলে ধরা ওই পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, একটি ড্রাইভার পদের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন ১০ হাজার চাকরিপ্রার্থী। ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য প্রার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল দশম শ্রেণি পাস। কিন্তু আবেদনকারীদের মধ্যে অনেকে ছিলেন স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিবিএস পাস। এমনকি দেশটির সিভিল জাজ পদের প্রার্থীরাও পিয়ন, গাড়িচালক ও ওয়াচম্যানসহ নানা নিম্ন পদের পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন।
গত সপ্তাহে, ভারতে একজন আইনে স্নাতক ড্রাইভার হিসাবে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন। জিতেন্দ্র মৌর্য নামের ওই চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘আমি ল গ্র্যাজুয়েট হয়েও গাড়িচালক পদে আবেদন করেছি। আমি বিচারক নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নিতেও প্রস্তুতি নিচ্ছি। মাঝেমধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বই কেনার মতো টাকা থাকে না। তাই ভেবেছি, যেমনই হোক না কেন, একটা চাকরি পেতে হবে।’
ওই পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা অজয় বাঘেল নামের আরেক প্রার্থী বলেন, ‘আমি সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। আমি পিয়ন পদের জন্য আবেদন করেছি। যারা পিএইচডি করেছেন, তাদের অনেকেই এ চাকরির জন্যও আবেদন করেছেন।’
ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্বেগ, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন বাড়ার সাথে সাথে চাকরি সঙ্কট আরও প্রকট আকারে সামনে আসবে।
বেশিরভাগ দেশে ২০২০ সালে বেকারত্ব বেড়েছে। কিন্তু ভারতের হার বাংলাদেশ (৫ দশমিক ৩ শতাংশ), মেক্সিকো (৪ দশমিক ৭ শতাংশ) এবং ভিয়েতনাম (২ দশমিক ৩ শতাংশ) এর মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে ভারতের বেকারত্ব উদ্বেগজনক কারণ দেশের প্রবৃদ্ধি আবার শুরু হওয়ার পরেও, তারা অন্যান্য দেশের তুলনায় সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে।
‘আমি সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট। আমি পিয়ন পদের জন্য আবেদন করেছি। যারা পিএইচডি করেছেন, তাদের অনেকেই এ চাকরির জন্যও আবেদন করেছেন।’
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর কৌশিক বসু বলেন, ‘সরকারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমিকদের সহায়তা করতে হবে।’ এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রী মোদির শাসনামলে ‘মেরুকরণ এবং ঘৃণার রাজনীতি’ সাধারণ মানুষের ‘বিশ্বাসের ক্ষতি’ করে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্নিহিত চালক।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগেই ভারতে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে। অতিমারির কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলেই আশঙ্কা।
গত বছরের মে মাসে ভারত সরকারের উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই যে সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে দেখা যায় বেকারের সংখ্যা শতাংশের নিরিখে দুই অংক ছাড়িয়ে গেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই তা ১৯ শতাংশে পৌঁছে যায়।
৬ জুনের সমীক্ষায় দেখা গেছে সব মিলিয়ে গোটা দেশে কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছেন ১৩ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে অধিকাংশ মানুষই গ্রামের। ২০২০ সালে সংখ্যাটি ২০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছিলেন।
এদিকে সর্বশেষ সমীক্ষা হয় ২৫ জুলাই। ভারতের পরামর্শক সংস্থা সিএমআইইর সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৫ জুলাই শেষ হওয়া সপ্তাহে সারা ভারতে বেকারত্বের হার এক ধাক্কায় ৭ দশমিক ১৪ শতাংশে উঠেছে। আগের সপ্তাহেই যা ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ ছিল। গ্রামাঞ্চলে সেই হার ৫ দশমিক ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শহরে তা অপেক্ষাকৃত কম বাড়লেও ছাড়িয়ে গিয়েছে ৮ শতাংশের সীমা। ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
বস্তুত শহরে বেকারত্বের হার অনেক দিন ধরেই গ্রামাঞ্চল এবং জাতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। সম্প্রতি সেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে দাবি করছিল কেন্দ্র। কিন্তু এ দফার সমীক্ষা প্রতিবেদন নতুন করে দুশ্চিন্তা বাড়াল। সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের উদ্বেগ, এর পরে সত্যিই করোনার তৃতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে আছড়ে পড়লে কর্মসংস্থানে তার কতটা প্রভাব পড়বে!
২০২০ সালের মার্চে করোনার হানার পর থেকেই ভারতে কাজের বাজার বিপর্যস্ত। দীর্ঘ লকডাউনের ধাক্কায় ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে বেকারত্বের হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এরপর লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে।
কিন্তু মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে সে পরিস্থিতি বদলে যায়। সংক্রমণ রোধ করতে রাজ্যগুলো স্থানীয় লকডাউন এবং বিধিনিষেধের পথে হাঁটায় আবারও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পায়। বাড়তে বাড়তে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে বেকারত্বের হার দুই অঙ্ক পেরিয়ে যায়। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় তা আবারও কমতে থাকে। সংশ্লিষ্ট মহলের ব্যাখ্যা, আর্থিক কর্মকাণ্ডে গতি আসা এবং বর্ষা মৌসুমের ওপর নির্ভর করেই বদলে যায় কাজের বাজারের অবস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় গত বছর লকডাউনের আগে থেকেই বেকারত্ব বাড়ছিল। ফলে করোনা মোকাবিলায় পুরো দেশ ঘরবন্দী হতেই বেকারত্বের হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আর্থিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে বেকারত্বের হার কমতে শুরু করে বটে, কিন্তু কর্মসংস্থানের গতি প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়েই ছিল। কাজকর্ম শুরু হলেও নিয়োগে ধারাবাহিক উন্নতি তেমন একটা চোখে পড়েনি।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা না দিলে এবং প্রতিষেধক প্রয়োগের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তাকে শুরুতেই শক্ত হাতে থামানো গেলে ভয় কাটত বলে মনে করছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহল। তাদের মতে, উৎপাদন এবং পরিষেবা বৃদ্ধির হাত ধরে অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো নিশ্চিত হলে নিয়োগও বাড়ত। কিন্তু সিএমআইই তথ্য বলছে, এপ্রিলে তা তো হয়নি, বরং কর্মী আরও কমেছে। এমনকি কাজ খুঁজতেও বেরিয়েছেন অনেক কম মানুষ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজ্যে রাজ্যে বিধিনিষেধ, লকডাউন জুড়ে দিলে ক্ষয়ক্ষতি দেশজুড়ে পূর্ণাঙ্গ লকডাউনের তুলনায় খুব কম কিছু নয়। এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন, খুচরা বিক্রি—সব কমে যাবে তা ধারণাতেই ছিল, কিন্তু তা আর কত দিন, সেটাই প্রশ্ন সব মহলের।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হ্রাস করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা। তবে লকডাউন উঠে গেলে আবারও অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে ক্রেডিট সুসি। তাতে চলতি অর্থবর্ষে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯২০
আপনার মতামত জানানঃ