মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে নানামুখি সংকট চলমান রয়েছে। দেশটিতে দারিদ্রতার পরিমাণ এতটাই যে, গত ২০ বছরের মধ্যে দেশটিতে এই পর্যায়ের দারিদ্র্য আর দেখা যায়নি। চলমান বিক্ষোভের পরিস্থিতিতে গভীরতর আর্থিক সংকটে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দ্রুত গতিতে বাড়ছে। অসংখ্য মানুষের চাকরি হারানো, খাবারের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা ইত্যাদি কারণে দেশটির নাগরিকদের খাদ্য জোগাড় করতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশটির হাজার হাজার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী থাইল্যান্ডে আশ্রয় খুঁজছে। খবর এএফপি
স্ত্রী ও ছয় বছরের সন্তান নিয়ে দেশ ছেড়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন মায়ো চিট। তার বাড়ি মিয়ানমারের উপকূলীয় তানিনথারি অঞ্চলে। সেখান থেকে জঙ্গল পেরিয়ে দুই দিনের যাত্রা শেষে পাচারকারীদের সহায়তায় তারা থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুড়ি প্রদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। নিজ দেশে সবই ছিল। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থান ও করোনা মহামারি এখন তাদের উদ্বাস্তু বানিয়েছে।
তবে দেশ ছাড়লেও স্বস্তিতে নেই মায়ো চিট দম্পতি। থাই পুলিশের হাতে আটক ও জোরপূর্বক দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ার আতঙ্ক প্রতি মুহূর্তে তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কাজ খুঁজতে সম্প্রতি তারা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের পাশে সাখোন প্রদেশে এসেছেন। মিয়ানমারের উদ্বাস্তুরা মূলত এখানে কাজ করে। সেখানে কাপড়ে রং করার একটি কারখানায় চাকরি পেয়েছেন। দৈনিক আয় ১০ ডলার। তবে অনিবন্ধিত হওয়ায় প্রতিনিয়ত থাই সরকারের নজরদারিতে থাকতে হচ্ছে তাঁদের।
৪৫ বছর বয়সী মায়ো চিট বলেন, ‘মিয়ানমারে আয়ের সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হয়ে এসেছে। দেশ ছেড়ে আসাটা কঠিন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের তাই করতে হয়েছে। এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। তাই মিয়ানমারে ফেরার সুযোগ নেই। এখানেও জীবন স্বস্তির নয়। আয়ও কম। সারাক্ষণ নজরদারিতে থাকতে হচ্ছে।’
মিয়ানমারের শ্রমিকেরা আগে থেকেই থাইল্যান্ডে এসে কাজ করেন। থাইল্যান্ডে প্রায় ২০ লাখ মিয়ানমার নাগরিক বসবাস করে এবং কাজ করেন। তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সীমান্ত বন্ধ। এর মধ্যেই মিয়ানমারে গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থান হয়। এর পর থেকে দেশটি অশান্ত অবস্থায় রয়েছে। তাই এখন অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পেরিয়ে থাইল্যান্ডে আসা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই।
জান্তার আমলে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডে কত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিগত মাসগুলোয় কয়েক হাজার উদ্বাস্তুকে গ্রেপ্তার করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে থাই সরকার। গত বছরের নভেম্বরে গ্রেপ্তারের এই সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়, যা গত জানুয়ারির চেয়ে ১০ গুণের বেশি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে এমন ৫৬০ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল থাইল্যান্ড।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা থাই অধিকারকর্মী রোইসাই ওংসুবান বলেন, জান্তার আমলে মিয়ানমারবাসীর কাজের সুযোগ ও আয় কমেছে। অর্থনৈতিক সংকটে বেড়েছে জ্বালানির দাম। খাবারের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। মহামারিতে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গেছে। এ কারণে দেশটির মানুষ কাজ খুঁজতে দলে দলে থাইল্যান্ডে আসছে।
মিয়ানমারে আয়ের সুযোগ ক্রমে সংকুচিত হয়ে এসেছে। দেশ ছেড়ে আসাটা কঠিন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের তাই করতে হয়েছে। এখন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
দীর্ঘদিন সীমান্ত বন্ধ থাকায় এখন মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডে প্রবেশে কিংবা থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমারে ফেরার জন্য বৈধ পথ খোলা নেই। ফলে মিয়ানমারের অনেক মৌসুমি শ্রমিক থাইল্যান্ডে আটকা পড়েছেন। তাদের অনেকেই জান্তার আমলে আর দেশে ফিরতে চান না। সস্তায় মিলে বলে থাইল্যান্ডে মিয়ানমারের শ্রমিকদের চাহিদাও রয়েছে বেশ। তবে অবৈধ উদ্বাস্তুদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলা হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে থাই সরকার। দেশটির সরকার জানিয়েছে, আটক হলে মিয়ানমারের উদ্বাস্তুদের অবশ্যই নিজ দেশে ফিরতে হবে।
অর্থনৈতিক সংকট পণ্য মূল্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, মিয়ানমারে এখন প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন, অভ্যুত্থানের আগে যা ছিল ১০ লাখ। এখন ৪৮ কেজির এক ব্যাগ চালের দাম ৪৮ হাজার কিয়েট, যা ফেব্রুয়ারি থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। গ্যাসের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। এক লিটারের দাম ১ হাজার ৪৪৫ কিয়েট। এই সংকট ব্যবসা-বাণিজ্যেরও মারাত্মক ক্ষতি করছে, বিশেষত যারা কাঁচামাল আমদানি করেন।
এদিকে দেশটির সামরিক বাহিনীর সাথে জান্তাবিরোধী গেরিলাদের ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন ভারত সীমান্তবর্তী থান্টলং শহরের বাসিন্দারা। প্রচণ্ড গোলাগুলির কারণে শহরের বহুসংখ্যক ঘরবাড়িতে আগুন লেগে যায়। এতে শহরে বসবাসকারী ১০ হাজারের বেশি লোক পালিয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, একটি এতিমখানার কিছু শিশু আর অভিযানরত সেনা সদস্যরা ছাড়া শহরটিতে আর কেউ নেই। এদের মধ্যে বহু লোক সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
মিয়ানমারের সংকট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, এমনকি এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে বৃহৎ সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘপ্রধান আন্তোনিও গুতেরেস। এমন ‘বহুমুখী বিপর্যয়’ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনে এ আহ্বান জানান সংস্থাটির মহাসচিব।
গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন, মিয়ানমারে সেনাশাসন প্রতিরোধের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসতে পারে। সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ফেরাতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দেশগুলোর সাহায্য জরুরি।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল বহাল অপরিহার্য। এটি আদায়ে প্রতিবেশী দেশগুলো মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, অং সান সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের অবিলম্বে মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এছাড়া রাখাইনে থেকে যাওয়া ছয় লাখ এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাসহ দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য দ্রুততম সময়ে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন।
সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সু চির সরকারকে হটিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গেই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন দেশটির সাধারণ মানুষ। শুরু হয় সংঘাত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের বেশি মানুষ।
মিয়ানমারের সংকট সমাধানে দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের পাঁচ দফা প্রস্তাবনায় সমর্থন জানিয়েছে জাতিসংঘ। ওই প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে— মিয়ানমারে সহিংসতা বন্ধ, গঠনমূলক আলোচনা, মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আসিয়ানের বিশেষ দূত নিয়োগ এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি।
গত আগস্টে ব্রুনাইয়ের দ্বিতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরিওয়ান ইউসুফকে মধ্যস্থতাকারী দূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আসিয়ান। এরই মধ্যে কাজও শুরু করেছেন তিনি। প্রতিবেদনে ইউসুফের নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘ প্রধান। অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, মিয়ানমার সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাবনা সময়মতো বাস্তবায়ন জরুরি। এ বিষয়ে আসিয়ানকে জাতিসংঘের বিশেষ দূতের সঙ্গে কাজ করতেও উৎসাহিত করেন গুতেরেস।
নিজ দেশের জনগণের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে দমনপীড়নের জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হয়েছেন জান্তাপ্রধান হ্লাইং। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের সেনাসদস্য ও সেনাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এরপরও কমেনি জান্তার দমনপীড়ন। পাল্টা-আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছেন সেনাশাসনের বিরোধীরা। দেশটিতে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমার দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৩
আপনার মতামত জানানঃ