ইয়েমেন সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই; জাতিসংঘের এই কথাকে পাত্তা না দিয়েই প্রায় সাত বছর ধরে যুদ্ধ চলছে ইয়েমেনে। শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ বেছে নেওয়ার জন্য যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে বারবারই আহ্বান জানিয়েও সাড়া মেলেনি। ইয়েমেনে যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতিই হতে দেখা গেছে শুধু। বেড়েছে মানুষের দুর্দশা।
জাতিসংঘ ইতিমধ্যে বলেছে, দেশটির জনগণ বিশ্বের সবচেয়ে মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে ৫০ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে আশ্রয়শিবিরে গাদাগাদি করে বসবাসে বাধ্য হওয়া লাখ লাখ মানুষের মধ্যে বাড়ছে করোনাঝুঁকি। তার মধ্যেই আবার বেড়েছে শীতের প্রকোপ।
আজীবন ক্ষমতায় থাকার মনোবাসনা নিয়ে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন। প্রতিবাদে জনতা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনকারীদের দমাতে ওই বছরের মার্চে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৫০ জন নিহত হয়। সরকারের দমন-পীড়নে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। তুমুল বিক্ষোভের মুখে একসময় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সালেহ।
ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জিহাদিদের হামলা, বেকারত্ব, দুর্নীতি, খাদ্য অনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন হাদি। নতুন প্রেসিডেন্টের এমন দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নেয় ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। অনেক সাধারণ ইয়েমেনি নাগরিকও তাদের সমর্থন দেয়।
২০১৫ সালের শুরুর দিকে রাজধানী সানা আক্রমণ করে মানসুর হাদির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে হুতি বিদ্রোহীরা। হাদি বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে ২০১৫ সালের মার্চে হাদি সরকারকে আবারও ক্ষমতায় আনতে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট।
হুতিদের পরাজিত করে ইয়েমেন থেকে ইরানের প্রভাব মুছে দিতে জোটটি বিমান হামলা চালাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকেও সৌদি জোটকে সহযোগিতা করা হয়। যুদ্ধের শুরুর দিকে সৌদি কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছিলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের অবসান হবে।
তবে অভিযানের প্রায় সাত বছর হতে চললেও ইয়েমেন থেকে সরে আসেনি সৌদি জোট। বরং এ যুদ্ধকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখা হয়ে থাকে এখন। বর্তমানে রাজধানী সানাসহ ইয়েমেনের বেশির ভাগ এলাকা হুতিদের দখলে। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা মারিবের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আছে সৌদি সমর্থিত মানসুর হাদির অনুগতরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (এসিএলইডি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বরের শুরু নাগাদ ইয়েমেনে ১ লাখ ৪৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আরেক সংস্থা ইয়েমেন ডেটা প্রজেক্ট বলছে, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বিমান হামলায় ৮ হাজার ৭৮০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়েমেনে লড়াইরত দুই পক্ষই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে থাকতে পারে।
ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযান শুরুর পর গত প্রায় সাত বছরে দেশটির মৌলিক সেবাব্যবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ইয়েমেনের দুই–তৃতীয়াংশ জেলার মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন এলাকায় সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।
সাত বছর আগে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মারিব প্রদেশে ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। তবে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন শহরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে এসব শহরের লাখো মানুষ অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল এলাকাগুলোতে পালাতে শুরু করে। অনেকে মারিবে আশ্রয় নেয়। এর পূর্বাঞ্চলীয় মরুভূমিতে অনেকগুলো অস্থায়ী তাঁবুতে গড়ে উঠেছে আল সুমিয়া আশ্রয়শিবিরটি। অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষের বসবাস সেখানে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মুখপাত্র (আইওএম) অ্যাঞ্জেলা ওয়েলস গত নভেম্বরে জানান, শুধু ওই মাসেই প্রায় ৬০টি পরিবার নতুন করে আল সুমিয়া শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। ইয়েমেন সরকারের তথ্য অনুযায়ী, মারিব প্রদেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য প্রায় ১৩৯টি আশ্রয়শিবির স্থাপন করা হয়েছে। এসব শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২২ লাখ মানুষ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের ১২ ডিসেম্বর নাগাদ দেশটিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, যুদ্ধকবলিত দেশটিতে পরীক্ষা ও তথ্য পাওয়ার সুযোগ কম থাকায় বাস্তব চিত্র তুলে ধরা কঠিন। দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী এবং ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে টিকা দিতে ইয়েমেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতা করছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা।
এসডব্লিউ/এসএস/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ