মাত্র কিছু বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন নবী মুহাম্মদ। এর মধ্যেই ইসলাম সমাজে শুরু হয়ে গিয়েছে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ। কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধে পর্যুদস্ত ইমাম হোসেন কাতরভাবে অনুরোধ করছেন শুধু পুত্র আলী আজগরের প্রাণভিক্ষার জন্য।
সেই আবেদনে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন। তাদের মুণ্ডিত মাথায় লম্বা টিকি। গলায় উপবীত। তারা ব্রাহ্মণ। ইমাম হোসেনের আহ্বানে সুদূর সিন্ধুতীর থেকে পৌঁছে গিয়েছেন আরবের মরুপ্রান্তরে। লড়াই করেছেন নবী মুহম্মদের পরিবারকে রক্ষা করার জন্য। অবশ্য শেষরক্ষা সম্ভব হয়নি।
কারবালার প্রান্তরের সেই পরাজয়ের স্মৃতিকে আজও বহন করে চলেছেন উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়, যাদের নামের সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে হোসেন শব্দটি।
হোসেনি ব্রাহ্মণদের মতে, আনুমানিক ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে, সেই সময়কার প্রায় ৫০০ ‘দত্ত’ ব্রাহ্মণ তাদের পূর্ব ইতিহাসের অংশ হিসেবে ইমাম হোসেন এর নামের ‘হোসেন’ অংশটি নিজেদের উপাধির অংশ করে নেন এবং নিজেদের ‘হোসেনি ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন।
উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই বিশেষ সম্প্রদায়টি দত্ত ব্রাহ্মণ বা হোসেনি ব্রাহ্মণ নামেই পরিচিত। তারা হিন্দু না মুসলমান, এই বিতর্কের মাঝে উঠে আসে একটাই কথা, ‘দত্ত-রা হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়’।
কিছুটা হিন্দু আবার কিছুটা মুসলমান, এই পরিচয় নিয়েই ভারতে রয়েছেন অন্তত ৫০ লক্ষ মানুষ। পাঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাটের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের বসতি।
কারবালার যুদ্ধে সত্যিই তারা অংশ নিয়েছিলেন কিনা, সেই ইতিহাস অবশ্য জানা যায় না। অন্তত যুদ্ধের ইরানীয় বিবরণে কোনো ভারতীয়ের অংশ নেওয়ার কথা নেই। তবে বংশ পরম্পরায় লোকমুখে যে ইতিহাস গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে সংস্কৃতির শিকড় জড়িয়ে থাকে কোন না কোনভাবে।
হোসেনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় গোত্র হিসাবে সরস্বত ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়েরই অংশ। সরস্বত ব্রাহ্মণদের সাতটি গোষ্ঠীর মধ্যে এরা মোহ্যাল গোষ্ঠীর অংশ। জ্ঞানবিদ্যার চর্চা ছাড়াও অস্ত্রচালনায় পারদর্শী ছিলেন মোহ্যাল ব্রাহ্মণরা। তাদেরই একজন ছিলেন রাহাব দত্ত। কারবালার যুদ্ধে ৭ সন্তানকে নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
জনশ্রুতি অনুযায়ী, যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় হিন্দুকুশ পর্বতের নির্জন উপত্যকায় স্থায়ীভাবে থেকে যান রাহাব দত্ত। দলের বাকিরা ফিরে আসেন পঞ্চনদীর অববাহিকায়। এখানেই গড়ে ওঠে নিজস্ব সংস্কৃতি। পাঞ্জাব অঞ্চলেও আরবি প্রভাবের এত প্রাচীন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
বরং ঐতিহাসিকদের অনুমান, তুর্কি আক্রমণের পর থেকেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে এই সংস্কৃতি। এই ইতিহাস ধর্মান্তকরণের ইতিহাস নয়। বরং বৈদিক রীতিনীতির সঙ্গে মানানসই ভাবেই ইসলামিক রীতিনীতিকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মানুষরা। আর সেই যৌথতায় মিলেমিশে গিয়েছে ইমাম হোসেনের নাম।
ব্রাহ্মণ হলেও হোসেনি ব্রাহ্মণদের সবচেয়ে বড়ো উৎসব মহরম। যে উৎসব মনে করিয়ে দেয় সেই কারবালার যুদ্ধের কথা। স্বাধীনতার আগে পর্যন্তও পাঞ্জাবের অমৃতসর সহ নানা জায়গায় হোসেনি ব্রাহ্মণদের কাঁধ না পেলে শুরু হত না মহরমের তাজিয়া। এখনও সেই নিরবিচ্ছিন্নতা বজায় রয়েছে নানা জায়গায়।
বছরের অন্যান্য নানা উৎসবেও হোসেনি মুসলমানরা পুজো শুরু করেন ইমাম হোসেনকে স্মরণ করে। এর মধ্যে দেশের মাঝখান দিয়ে কাঁটাতার বয়ে গিয়েছে। দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়েছে সীমান্ত প্রদেশ। কিন্তু হোসেনি ব্রাহ্মণদের কেউই হিন্দু বা মুসলমান বলে শনাক্ত করেননি। ভারতের মতোই তারা ছড়িয়ে রয়েছেন পাকিস্তানেও। এমনকি আফগানিস্তানেও কয়েক হাজার হোসেনি ব্রাহ্মণের বাস।
মীর মোশারফ হোসেন-এর ‘বিষাদ সিন্ধু’তে আজর নামে যে ব্যক্তির কথা উল্লেখ আছে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ভারতীয় লোক। মোফারফ হোসেন হয়তো এরকম কোন ঘটনা শুনেই বিষাদ সিন্ধু’তে আজর চরিত্রটি যুক্ত করে থাকতে পারেন। মুসলমানদের কাছে তারা কাফের। আর হিন্দুদের কাছে তারা মুসলমান। তবে এই উপমহাদেশের চিরাচরিত বহুত্ববাদের সংস্কৃতিকেই আগলে রেখেছেন তারা-ই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯০০
আপনার মতামত জানানঃ