কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিতে গতি ফিরেছে। এতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হতেই যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কেনাকাটা বাড়তে শুরু করেছে। আবার সামনে বড়দিন। তাতে দেশটির ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান পোশাকের ক্রয়াদেশ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি-অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশ থেকে ৬ হাজার ৬৯১ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক আমদানি করেন। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশ। আর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ, উল্লিখিত সময়ে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি করেছে ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের, যা গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
অবশ্য দেশটিতে রপ্তানির শীর্ষ দশে থাকা অপর ৬টি দেশের মধ্যে ৪টি দেশের প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য আমদানির হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ‘দ্য অফিস অফ টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল’ (ওটেক্স) প্রকাশিত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশি পোশাকের বড় বাজার। তবে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বাজারটিতে রপ্তানি কমে যায়। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। ইতিমধ্যে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নেও ব্যাপক অগ্রগতি হয় বাংলাদেশের। তাতে শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালে ৫৯৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। গত বছরও শুরুটা দুর্দান্ত হয়েছিল। পরে অবশ্য করোনার থাবায় রপ্তানি নিম্নমুখী হতে থাকে। বছর শেষে ৫২৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ২০২০ সালে।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, মোটাদাগে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা সামগ্রিকভাবে পোশাক আমদানি যে হারে বাড়িয়েছেন, সেটিকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের রপ্তানি। তাতে প্রথমবারের মতো দেশটিতে ১ বছরে ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানির মাইলফলক অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যান্য দেশের রপ্তানি পরিস্থিতি
দেশটির বাজারে শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন। উল্লিখিত সময়ে চীন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
শীর্ষ ৪ রপ্তানিকারকের মধ্যে বাকী ৩টি দেশ হলো যথাক্রমে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের রপ্তানি বৃদ্ধির হার ছিল ২৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের প্রায় ১৪ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ছিল ১০ শতাংশের কিছু বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ ১০টি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে অপর ৬টি দেশ হল যথাক্রমে ভারত, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। এর মধ্যে উল্লিখিত ১০ মাসে ভারত, মেক্সিকো, হন্ডুরাস ও পাকিস্তানের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। তবে, দেশগুলোর রপ্তানির পরিমাণ বাংলাদেশের চেয়ে কম।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদী রপ্তানিকারকরাও। নারায়নগঞ্জভিত্তিক পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এমবি নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, চীন, ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন কারনে উৎপাদন ব্যহত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাংলাদেশ মুখী হচ্ছেন। এর ফলে রপ্তানি বাড়ছে।
নতুন করে ইনকোয়ারি (পোশাক ক্রয়ের জন্য প্রাথমিক আলোচনা) বাড়ছে। ফলে আগামী মাসগুলোতেও পোশাক রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেয় না। ফলে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে দেশটির বাজারে প্রবেশ করতে হয়। তারপরেও সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ভালো।
তিনি আরও বলেন, অন্তপক্ষে দেশের তুলা দিয়ে তৈরি পোশাকও যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওই বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়, তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোঃ শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের আরও বেশি রপ্তানি হতে পারতো। কিন্তু কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বেশি হওয়ায়, অনেক রপ্তানিকারক উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে মেলাতে না পেরে রপ্তানি আদেশ দিতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়লে তা ক্রেতার কাছ থেকে চাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের দেশে লজিস্টিকসসহ অন্যান্য কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়লে তা ক্রেতারা দিতে চান না।
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রচুর ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোও ক্রেতাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না।
তাই সব মিলিয়ে আমাদের উদ্যোক্তারা ভালো ক্রয়াদেশ পাচ্ছেন। করোনার নতুন ধরন অমিক্রনে যেহেতু মৃত্যুর খবর নেই, তাই আপাতত মহামারি নিয়ে দুশ্চিন্তা কম। আগামী মাসগুলোতেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি থাকবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ