প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের চিকিৎসা কাজে যুক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এখন পর্যন্ত কোনো প্রণোদনা ভাতা পাননি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে চিঠি চালাচালি করতেই ছয় মাস চলে গেছে। কবে তারা প্রণোদনা পাবেন, সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না। ফলে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে হতাশা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়েই শঙ্কায় পড়ে গেছেন সামনের সারির এই করোনাযোদ্ধারা। এদিকে করোনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনদান অব্যাহত আছে। গেল নভেম্বর ২০২০ মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৯ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।
গত ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘মার্চ মাস থেকে যারা কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছেন, সরকার তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেবে। এ ছাড়া দায়িত্ব পালনের সময় কেউ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে তাদের জন্য ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার একটি স্বাস্থ্যবিমা থাকবে। কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবিমার পরিমাণ পাঁচ গুণ বেশি হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে এবং করোনায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি বাড়তে থাকায় সরকার গত ১ জুলাই করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর গত ১৬ মের হিসাবে উদ্বেগজনক চিত্র ধরা পড়ে। দেখা যায়, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে করোনা সংক্রমণের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তখন মোট সংক্রমিত ব্যক্তিদের ১১ শতাংশই ছিলেন স্বাস্থ্যকর্মী। এই হার বৈশ্বিক হারের চেয়ে সাত গুণ বেশি ছিল। চিকিৎসকরা মৃত্যু ছাড়াও ক্লান্তি ও ভীতির ঝুঁকিতে ছিলেন। এ ছাড়া তাদের শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যারও শঙ্কা করা হয়। এর প্রেক্ষিতেই চিকিৎসকদের প্রণোদনা ভাতা দেয়ার বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল সংশ্লিষ্টরা পাননি।
জানা গেছে, প্রণোদনা খাতে বরাদ্দ চেয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে কর্মরত প্রত্যেক চিকিৎসক দৈনিক ২ হাজার টাকা করে মাসে ১৫ দিন, নার্স ১ হাজার ২০০ টাকা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে ৮০০ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়। ঢাকার বাইরে চিকিৎসকেরা যথাক্রমে ১ হাজার ৮০০ টাকা, নার্স ১ হাজার টাকা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৬৫০ টাকা পাবেন। তবে যেসব চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সরকারের কাছ থেকে আবাসন সুবিধা নিয়েছেন, তারা এই প্রণোদনা পাবেন না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভূতাপেক্ষ প্রণোদনা সুবিধা পাবেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকের সংখ্যা ৫ হাজার ৭২৬, নার্স ১০ হাজার ৪৪ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ৮ হাজার ৫১৫। তাদের সবাইকে ভাতা দিতে সরকারের মাসে খরচ হবে ৩৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি চিকিৎসাসেবীদের মধ্যে কতজন এই প্রণোদনা পাবেন।
করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম দিকে স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার জন্য চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সরকারি খরচে হোটেলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী যেসব চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনা রোগীদের ১৫ দিন চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, পরবর্তী ১৫ দিন তাদের কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। কিন্তু চিকিৎসকদের হোটেলভাড়া ও খাবারের অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। পরবর্তীকালে সরকার তাদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনাযুদ্ধের সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের পরিবারকেও উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেই সহায়তা পেয়েছেনও। বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৭৬ জন, নার্স ১ হাজার ৯৭৩ আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ২৭৬ জন। করোনায় এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১১০জন চিকিৎসক। ৩০ নভেম্বর ২০২০ গতকাল হালনাগাদকৃত এক ঘোষণায় তারা এও জানিয়েছে যে, গত মাসে ৯ জন চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, তারা সরকারের কাছে প্রণোদনা চাননি। সরকার স্বেচ্ছায় এটি ঘোষণা করেছে। এখন এ নিয়ে অযথা বিলম্ব কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তাদের জন্য অসম্মানজনক। অবিলম্বে করোনার চিকিৎসারত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা হোক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ইমতিয়াজ হাসান বলেন, এটা হতাশাজনক। আমরা ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেছি। এখন সরকারের প্রতিশ্রুত প্রণোদনা পেলে কিছু সুবিধা হয়। কিন্তু এটা তো সেই কবে থেকে শুধু শুনছি। আমি নিজে আশা ছেড়ে দিয়েছে। পেলে বাড়তি, না পেলে নেই। চিকিৎসকরা এমনিতেই অবহেলিত। আমার মতে, করোনার প্রণোদনা পাই বা না পাই সরকার যেন চিকিৎসা খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ায়। তাহলে চিকিৎসক ও রোগী, সবার জনই ভালো হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক রেজিস্ট্রার, চিকিৎসক ও সংগঠক অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ স্টেটওয়াচ ডটনেটকে বলেন, ‘গভর্নমেন্ট পুলিশেদের যে পরিমাণ প্রণোদনা দিয়েছে, এখানে শুধুমাত্র ওই যে প্রথম যে ডাক্তার মারা গেছে সিলেটের, শুধু ওর পরিবারই ডাক্তার পেয়েছে, আর কেউ পায়নি। এর দুইটা কারণ গভমেন্টের দিক থেকেও ডাক্তারদের নেগলেক্ট করা হচ্ছে, এট দ্যা সেমটাইম ডাক্তাররাও সংগঠিত না। বিএমএ বা স্বাচিপ এই সমস্ত সংগঠন সক্রিয়ভাবে ভূমিকা না নেয়ার জন্য এই প্রবলেমগুলো হচ্ছে।’
ডক্টরস প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলস হেলথের অন্যতম সংগঠক এই চিকিৎসকের মতে, ‘দাবি যদি আদায় করতে হয়, তাহলে তো সংগঠিত উদ্যোগ থাকা দরকার। সেটা না করার ফলে, বিএমএ বা স্বাচিপ দুইটাই সরকারি দলের সাথে যুক্ত থাকার ফলে, তারা এই ভয়ে ফেস করতে পারছে না। আমরা যেহেতু কিছু করতে পারি না। আপনার ওই যে এখানে কিছু কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডাক্তার ক্লাব ফরমস আরো কয়েক জায়গা থেকে কিছু কিছু দাবি উঠানো হচ্ছে। কিন্তু এখনো সেভাবে কোন এমন কোন উদ্যোগ হয় না, যেটা গভর্নমেন্টর ভিতর কোনো পেশার তৈরি করতে পারে।’
বিশ্বে তো বটেই ঝুঁকি ভাতা বাংলাদেশের শ্রম আইনেও অনুমোদিত। ফলে করোনায় কাজ করা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনা একটি ন্যায্য দাবি। তাছাড়া সরকার নিজে এ ঘোষণা দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি এটা। এখানে হেলাফেলা করার কোন সুযোগ নেই। চিকিৎসক নেতারা মনে করছেন, আমলাদের প্রভাবের কারনে তাদের এসব সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। আমলারা চর দখলের মতো করে এগোচ্ছে এবং মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসকদের পদগুলো দখল করে ফেলছে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন বিএমএ’র নেতারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড় করতে হবে এবং আমলাদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সমস্যার জায়গাটাও সমাধান করতে হবে।
এসডাব্লিউ/আরা/১৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ