সরকারি প্রকল্প নির্ধারিত সময় আর অঙ্কের মধ্যে শেষ করা এ দেশে যেন আইনত অপরাধ। বাস্তবায়ন কাজে মন্থর গতির কারণে মেয়াদ ও অর্থ বৃদ্ধি এক নিয়মিত ঘটনা। এক্ষেত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সরকারি বিভাগটির কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় ৮৭৩ শতাংশও বেড়েছে।
এই দেরির জন্য প্রকল্প চলাকালীন অবস্থায় নকশা ও উৎস পরিবর্তন, অর্থায়নের ধরন বদলানো এবং তহবিল ছাড়করণে দীর্ঘসূত্রিতাকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা। এছাড়া, বেশিরভাগ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণ না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়করা নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও জানান তারা। মহামারির কারণে প্রকল্পের গতি আরো কমে গেছে।
বর্তমানে রেলওয়ের চলমান প্রকল্পের সংখ্যা ৪১টি। যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে অন্তত ২০টি প্রকল্পের মেয়াদ এক থেকে চারবার পর্যন্ত বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বেড়েছে বিপুল পরিমাণে।
প্রকল্প: ১
দেশে একটি শক্তিশালী এবং সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থার জন্য ট্রেন পরিষেবা বৃদ্ধি এবং এর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য ২০১৩ সালে অনুমোদিত রেলওয়ের প্রথম মহাপরিকল্পনা অনুসারে প্রকল্পগুলি নেওয়া হয়েছিল।
মাস্টারপ্ল্যানের ফেইজ-ভিত্তিক ভিশনের আওতায়, ২০১৯-২০২৩ মেয়াদে রেলওয়ের কাছে ৩৪৬টি লোকোমোটিভ ও ১ হাজার ৮৩২টি কোচ থাকার কথা। অথচ বর্তমানে সেবা দানকারী সংস্থাটির হাতে রয়েছে মাত্র ২৪৯টি লোকোমোটিভ এবং ১ হাজার ৬৭১টি কোচ। রেলওয়ের সাম্প্রতিক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারেই জানা গেছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুসারে, ২০১১ সালের জুলাইয়ে ৭০ মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহের প্রকল্প নেওয়া হয়। এর নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত ছয় বছর। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় প্রক্ষেপণ করা হয় ১ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। এই ক্রয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগ্রহী দরদাতাদের জন্য ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনবার দরপত্র আহবান করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে কেউই তাতে সাড়া দেয়নি।
এরপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয় কোম্পানি হুন্দাই রোটেম এর সাথে লোকোমোটিভ ক্রয়ের ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকার একটি চুক্তি সই হয়। এতে অর্থায়ন করার কথা ছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং জাপানের সুমিতোমো মিতসুই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের।
তবে ১৫ শতাংশের বেশি সুদ হওয়ায় একে কঠিন শর্তের ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে এটি গ্রহণে অসম্মতি জানায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। ফলে এই ঋণ চুক্তি আর এগোয়নি। তারপরেও, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ তিনবার বাড়িয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত করেছে।
প্রকল্প: ২
প্রায় ৬৫ কিলোমিটারের খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন অত্যন্ত ধীর গতির রেল প্রকল্পের আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১০ সালে ডিসেম্বরে এ প্রকল্প শুরু হয়, যা ২০১৪ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে এর বাস্তবায়ন ঝুলে আছে। এর মেয়াদ আরো দেড় বছর বাড়ানো হয়েছে।
সব মিলিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে চার বার। প্রাথমিক ব্যয় ১ হাজার ৭২১ কোটি টাকা ধরা হলেও, তা থেকে প্রায় ১২১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।
শুরুর পর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ শতাংশ। এখন এটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প: ৩
ট্রান্স-এশীয় রেল করিডরের সাথে সংযোগ স্থাপন এবং পর্যটন নগরে যোগাযোগ সুবিধা বাড়াতে ২০১০ সালে দোহাজারী- কক্সবাজার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। এ প্রকল্পের মেয়াদও কয়েকবার বাড়িয়ে সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২২ সালের জুন মাস।
এক দশক পরও চলতি বছরের অক্টোবর নাগাদ বাস্তবায়নে সার্বিক অগ্রগতি ছিল ৬৪ শতাংশ। জানা যায়, ১২৮ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ স্থাপনে এটি শুরু করা হয়। তবে তিন বছর পরই কর্তৃপক্ষ আগের সিদ্ধান্ত বদলে ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে আরো ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন দেখা দেয় এবং খরচও বেড়ে যায়।
প্রকল্পের নকশাও বদলেছে। ফলে ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার প্রাথমিক ব্যয় ১০ গুণ বেড়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখে পৌঁছেছে।
প্রকল্প: ৪
প্রতিবেশী ভারতের সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে ২০১০ সালে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। যা ২০১৭ সালের জুনে শেষ করার লক্ষ্য ছিল।
বেশ কয়েকবার মেয়াদ বাড়িয়েও ১০ বছর পর এর বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭০ শতাংশ।।এখন ২০২২ সাল নাগাদ ৫২.৫৪ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হলেও, গত ছয় মাসে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাছাড়া, দেশ প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪০৭
আপনার মতামত জানানঃ