মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘গণতন্ত্র সম্মেলন’ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা এবং সমালোচনা চলছে। চলতি মাসের ৯-১০ তারিখ অনলাইনে বিশ্বের ১০০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে তার এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাইডেন প্রশাসন থেকে বারবার আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ট্রাম্পের চার বছরে আমেরিকা বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসার থেকে সরে এসেছে। গণতন্ত্র প্রসারের বদলে এই সময়ে কর্তৃত্ববাদের হাত শক্ত হয়েছে। বাইডেন এই প্রবণতা বদলাতে চান, গণতন্ত্র প্রসারে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনে সম্মেলন কতটা কার্যকরী তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
বায়বীয় অঙ্গীকারনামা
শুধু অঙ্গীকারে গণতন্ত্রের কোনও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি আজও। বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক গণতন্ত্র সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আমন্ত্রিত দেশগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের অঙ্গীকার নবায়ন করবে এবং গণতন্ত্র রক্ষার একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানাবে, আশা ছিল এমনটি। মুখে মুখে সবাই তেমন অঙ্গীকার করেছে বটে, কিন্তু এই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের অঙ্গীকার আদৌ কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জড়ো হচ্ছে সর্বস্তরে।
প্রথম সন্দেহ সম্মেলনের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। আমেরিকায় গণতন্ত্র এই মুহূর্তে বিপুল হুমকির সম্মুখীন। এক বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখনো সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির ৬৮ শতাংশ সমর্থক মনে করে, এই মুহূর্তে যে লোকটি হোয়াইট হাউস দখল করে আছনে, তিনি একজন প্রতারক।
নির্বাচনে আসলে যিনি জিতেছেন, তার কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনে সেই ট্রাম্প আবারও ফিরবেন, এমন কথা খোলামেলাভাবেই বলা হচ্ছে।
মার্কিন সরকার বরাবরই গণতন্ত্র প্রসারে নিজের অঙ্গীকার জোরেশোরে প্রচার করতে ভালোবাসে। তাদের যুদ্ধও গণতন্ত্রের প্রসার। বিশেষজ্ঞরা, সম্মেলনের আমন্ত্রিতদের তালিকা দেখে মনে হয়েছে, বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের সুরক্ষা নয়, আমেরিকা এই সম্মেলন আয়োজন করেছে নিজের দল ভারী করতে। এ কথা বলার কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যাদের মিত্র বলে মনে করে, শুধু তাদেরই দাওয়াত পাঠিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বৈরিতা তীব্র হচ্ছে, এই বৈরিতায় আমেরিকা আমন্ত্রিত দেশগুলোকে নিজের পাশে চায়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ফেলো আনাতোল লিয়েভেনের কথায়, সম্মেলনের উদ্যোগটাই ভ্রান্ত। কেন তা বুঝতে শুধু নরেন্দ্র মোদি এই নামটা উচ্চারণ করাই যথেষ্ট। এই সম্মেলনের একটা উদ্দেশ্য চীনা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধা, কিন্তু মোদিকে বাদ দিয়ে সে জোট বাঁধা যাবে না। অতএব মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার সরকারের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র অস্বীকার করলে পুরো সম্মেলনই পরিহাসে পরিণত হয়। আর হয়েছেও তাই।
লিয়েভেনের মতো টাইম ম্যাগাজিনও মনে করে, আসলে এই সম্মেলন ‘ফারস’ ছাড়া আর কিছু নয়। এই সম্মেলনে এমন একাধিক সরকারপ্রধান আমন্ত্রণ পেয়েছেন, যারা খোলামেলাভাবে কর্তৃত্ববাদী। এসব রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাইডেন প্রশাসন ‘কপটতার’ প্রমাণ রেখেছে।
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো জেমস স্ট্রব ওয়েব পত্রিকা ‘পলিটিকো’তে এক নিবন্ধে মন্তব্য করেছেন, যে ‘মস্ত তাঁবুর’ কথা হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, তার পেছনে একধরনের ভূরাজনৈতিক অঙ্ক কাজ করেছে। তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কারণ, চীনের বিরুদ্ধে সে আমেরিকার কৌশলগত মিত্র। একইভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজের ছাতির তলায় ধরে রাখতে পোল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যদিও দেশটি দ্রুত সংখ্যাধিক্যের একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্র হয়তো মার্কিন বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে রয়েছে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের ঊর্ধ্বে তার অবস্থান নয়।
পাকিস্তান এবং ফিলিপাইন প্রায়শই ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ এবং অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের জন্য দোষী, উভয় সরকারের প্রতিনিধিরা বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে অংশ নেন। নাটকীয়ভাবে স্বৈরাচারী অনুশীলনে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও, ভারত ও ব্রাজিলকে গণতন্ত্রের প্রচারে ‘ইনপুট’ দেওয়ার সম্মান দেওয়া হয়েছে।
কসোভোর রাজনৈতিক অভিজাতদের প্রধান সদস্যরা একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সামনে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এই মামলার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবন্দীদের পরিকল্পিত হত্যার জন্য তাদের অঙ্গ আন্তর্জাতিক কালোবাজারে বিক্রি করা। মূলত গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থাকার পরও উল্লেখযোগ্য ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে ওয়াশিংটন কৌশলগত উদ্দেশ্যের জন্য অনেক দেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানায়।
আমাদের জানানো হয়েছে, এ বছর যে সম্মেলন হয়ে গেল, সেটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রথম পদক্ষেপ। এক বছর পর এই প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপে নেতা-নেত্রীদের সরাসরি উপস্থিতিতে যে শীর্ষ সম্মেলন হবে, তাতে হিসাব কষে দেখা হবে কোন দেশ তাদের অঙ্গীকার পালনে কতটা অগ্রসর হলো। অনেকটা সম্প্রতি ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের মতো, যেখানে বিভিন্ন দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কে কী করবে, তার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্র সম্মেলনে কোনো লিখিত-পড়িত অঙ্গীকার নেই।
বিশাল অঙ্কের অর্থের টোপ
তবে বাইডেন প্রশাসন যে কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে, হোয়াইট হাউস সে কথায় বিশ্বাস করে। বাইডেন প্রশাসন ঘোষিত এই কর্মসূচিতে রয়েছে পাঁচটি আদর্শিক লক্ষ্য। দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণতান্ত্রিক সংস্কার, গণতন্ত্রের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার, মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচনের সুরক্ষা ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে অবস্থান।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মার্কিন সরকার মোট ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের এক বিশেষ তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। ইউএস এইডের ব্যবস্থাপনায় এই অর্থ নানা প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হবে। যেমন নাগরিক স্বার্থে তথ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সমর্থনে থাকছে ৩০ মিলিয়ন ডলার, মিথ্যা ডিজিটাল মামলায় ফেঁসে যাওয়া সাংবাদিকদের সাহায্যের লক্ষ্যে থাকছে ৯ মিলিয়ন ডলার, দুর্নীতি দমনে সুশীল সমাজকে সাহায্য করার জন্য থাকছে ৫ মিলিয়ন ডলার ইত্যাদি।
আমেরিকার এই অর্থ দিয়ে গণতন্ত্রের কোনও উন্নতি হবে না, তা আমরা জানি। তবে ইউএসএইডের এই অর্থ কীভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন, সে কথা ভেবে ইতিমধ্যেই অনেকের জিভে ঝোল পড়া শুরু হয়েছে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ