মিয়ানমারের একজন স্থানীয় ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক কো সোয়ে নাইং সামরিক হেফাজতে মারা গেছেন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলমান ধর্মঘটের ছবি তোলার সময় গত সপ্তাহে তিনি গ্রেপ্তার হন। তার সহকর্মী এবং তার পরিবারের একজন বন্ধু মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছেন। খবর আল-জাজিরা।
গত ফেব্রুয়ারিতে অং সান সুচির নির্বাচিত সরকার হটিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম কোনো সাংবাদিক নিহতের কথা জানা গেল। যদিও সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলের পর শতাধিক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে। পরে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হওয়াদের অর্ধেক ছেড়েও দিয়েছে তারা।
প্রতিবাদ বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিক কো সোয়ে নাইং মিয়ানমারে সামরিক জান্তার হেফাজতে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা ও পারিবারিক এক বন্ধু। সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী শুক্রবারের ‘নীরব প্রতিবাদ’-এর খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময় ইয়াঙ্গুন থেকে তাকে ও এক সহকর্মীকে আটক করে সামরিক জান্তা। তাদের হেফাজতেই মারা গেছেন সাংবাদিক কো সোয়ে নাইং।
সাংবাদিক কো সোয়ে নাইং একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। পাশাপাশি তিনি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছিলেন। শুক্রবার ইয়াঙ্গুনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ হয়। কয়েক মাসের মধ্যে এটা ছিল সবচেয়ে কড়া প্রতিবাদ। এদিন মানুষ রাস্তায় নামেনি। তাদেরকে বাড়িতে থাকার আহ্বান জানানো হয়েছিল। ৬ ঘন্টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল। তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। ফলে রাস্তাঘাট ছিল একেবারে ফাঁকা।
খবরে বলা হচ্ছে, সোয়ে নাইং এবং তার সহকর্মী কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের সঙ্কটকে গণমাধ্যমে তুলে ধরছিলেন। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তার তোলা ছবি প্রকাশিত হয়। গ্রেপ্তারের পর সোয়ে নাইংকে ইয়াঙ্গুনের ইস্টার্ন বোটাহটাং টাউনশিপের একটি সামরিক জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে পাঠানো হয় বলে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে তার পরিবারকে জানানো হয়, নাইং ইয়াঙ্গুনের মিঙ্গালাডন টাউনশিপের ১ হাজার শয্যার ডিফেন্স সার্ভিস জেনারেল হাসপাতালে মারা গেছেন।
এপির একটি তদন্তে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর দখল নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমার জুড়ে জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রগুলো বন্দীদের ওপর ক্রমামগত নির্যাতন করে যাচ্ছে। একজন সেনা দলত্যাগকারী এপিকে বলেছেন, তিনি চিন রাজ্যের একটি সেনা ঘাঁটির অভ্যন্তরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে সৈন্যদের নির্যাতনে দুই বন্দীকে হত্যা করতে দেখেছেন।
ক্ষমতা দখলের পর বিক্ষোভ দমনে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ঠেকাতে তৎপর হন মিয়ানমারের জান্তারা। এ জন্য সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করাই তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের গ্রেপ্তার করা ছাড়াও বেশ কিছু গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। অনেকে আবার গোপনে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারি হেফাজতে কো সোয়ে নাইংই প্রথম মারা গেছেন এমন নয়। তবে এভাবে কতজন মারা গেছেন তা স্পষ্ট নয়। অন্য যারা নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেছেন, তার মধ্যে আছেন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ক্ষমতা হারানো নেত্রী অং সান সুচির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সদস্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৃতদেহ দেখা গেছে। তাতে মারাত্মক নির্যাতনের চিহ্ন আছে বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার বিষয়ক নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে সামরিক জান্তার গ্রেপ্তার টার্গেটে রয়েছেন সাংবাদিকরা। মুক্ত তথ্যপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে এটা করা হচ্ছে। এ জন্য তারা আটক করছে মিডিয়াকর্মীদের। জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছে অনেক মিডিয়া আউটলেট।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, জান্তা সরকারের সেনাদের হেফাজতে যারাই এ পর্যন্ত মারা গেছে তাদের সবার দেহে নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর আগে যারা নিহত হয়েছে তারা সবাই ছিলেন সুচির রাজনৈতিক দলের কর্মী। তবে সাংবাদিকদের বেশিরভাগই পরিকল্পিতভাবে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী একাধিক গণমাধ্যমের নিবন্ধন বাতিল করেছে, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট সম্প্রচারে বিধিনিষেধ দিয়েছে, কয়েক ডজন সাংবাদিককে আটক করেছে। এসবের মাধ্যমে সামরিক জান্তা সত্যকে চেপে রাখতে চাইছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনে নামে দেশটির সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর পর থেকেই সহিংস ঘটনা ঘটছে দেশটিতে। দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে অন্তত ১২শ জনের। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। আটক করা হয়েছে বহু আন্দোলনকারীকে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরাও।
সামরিক অভ্যুত্থান বিরোধী শুক্রবারের ‘নীরব প্রতিবাদ’-এর খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন তিনি। এ সময় ইয়াঙ্গুন থেকে তাকে ও এক সহকর্মীকে আটক করে সামরিক জান্তা। তাদের হেফাজতেই মারা গেছেন সাংবাদিক কো সোয়ে নাইং।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির গণতন্ত্রপন্থি মানুষের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকেরাও দমনপীড়ন, হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রায় ৮০ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে ৫০ জন এখনো বন্দী।
এর প্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। চাপ আসতে থাকে। সামরিক সরকারের নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবরোধ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আসিয়ানের অবস্থান। তারা কার্যত আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, গত এপ্রিলে মিয়ানমার আসিয়ানে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া। মানবিক সহায়তা দেয়ার পথ উন্মুক্ত করা এবং বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। এর মধ্যে কোনোটিই বাস্তবায়ন করেনি সামরিক জান্তা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সংঘাতপ্রবণ এলাকার বাইরে সংবাদকর্মীদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। সংবাদ প্রকাশের কারণে চলতি বছর বিশ্বে ২৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন এবং বিভিন্ন দেশে কারাবন্দী আছেন ২৯৩ জন।
সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার অলাভজনক বৈশ্বিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) নতুন প্রকাশিত একটি রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক আটকের ঘটনা ঘটেছে চীনে। বছরের শুরু থেকে গত ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫০ জন সাংবাদিককে আটক করেছে দেশটি। এরপরই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিয়ানমারে আটক করা হয়েছে ২৬ সাংবাদিককে। এছাড়া মিসরে ২৫ জন, ভিয়েতনামে ২৩ জন এবং বেলারুশে ১৯ জন সাংবাদিককে আটকের ঘটনা ঘটেছে। সাংবাদিকদের ধরপাকড়ের ঘটনায় তুরস্ক, ইরিত্রিয়া, সৌদি আরব এবং ইরান রয়েছে তালিকায়।
সাংবাদিক হত্যায় দায়মুক্তির প্রবণতা খুব বেশি। ইউনেসকোর তথ্য মতে, এ ধরনের ১০টি ঘটনার প্রায় নয়টিতেই কারও সাজা হয় না। সংঘাতের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি সংঘাত ছাড়াও সংবাদকর্মীদের মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপর পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায় যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
অনেক দেশেই দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানে গিয়ে সাংবাদিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া, অপহরণ, নির্যাতন, ডিজিটাল ও অন্যান্য মাধ্যমে গুজব রটানোসহ নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। নারী সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে অনলাইন সহিংসতার মাত্রা বেশি বলেও জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, সাংবাদিকরা আরও অগুনিত হুমকির মুখোমুখি হচ্ছেন। যেমন—অপহরণ, নির্যাতন ও গুম থেকে শুরু করে গুজব রটানো ও হয়রানি, বিশেষত ডিজিটাল মাধ্যমে, অনেক ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নারী সাংবাদিকরা বিশেষত অনলাইন সহিংসতার ঝুঁকিতে বেশি।
তিনি বলেন, সমাজের ওপর সামগ্রিকভাবে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কারণ তারা তথ্যপ্রাপ্তির মাধ্যমে মানুষকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহযোগিতা করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভুল তথ্যের ছায়া মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে যে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য সত্যিকার অর্থেই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। তথ্যপ্রাপ্তি যখন হুমকিতে পড়ে, তখন তা এমন বার্তা পাঠায়, যা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনও রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে, তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে। যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। জনসাধারণের কথাই উঠে আসে গণমাধ্যমে। তাই এই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত না করতে পারলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৫
আপনার মতামত জানানঃ