চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা উত্তেজনা বর্তমানে এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। চীন গণতান্ত্রিক এই ভূখণ্ডকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে থাকে। সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষা অঞ্চলে চীনের সামরিক বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় উত্তেজনার পারদ এখন চরমে।
তাইওয়ান চীনের বারবার কাছাকাছি সামরিক তৎপরতাকে ‘ধূসর অঞ্চল’ যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছে। তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তার সর্বশেষ হুমকি মূল্যায়নে বলেছে, সৈন্য অবতরণ এবং বন্দর ও বিমানবন্দরগুলি জব্দ করে তাইওয়ানে একটি সম্পূর্ণ চীনা আগ্রাসন অর্জন করা খুব কঠিন হবে, কারণ চীনের সৈন্য অবতরণ এবং সরবরাহে সমস্যা হবে।
তাইপেই এবং বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা, যা গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত দ্বীপটিকে তার নিজস্ব অঞ্চল বলে দাবি করে, গত দুই বছরে চীন তাইওয়ানের কাছে সামরিক তৎপরতা বাড়ায় চীনের শাসন মেনে নিতে চাপ দেওয়ার জন্য।
চীনের সেনা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্যই নিকট ভবিষ্যতে তাইওয়ানে সর্বাত্মক সেনা অভিযান চালানো সম্ভব হবে না দেশটির পক্ষে। তাইওয়ানের আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে এই দাবি জানিয়েছে দ্বীপ ভূখণ্ডের সেনাবাহিনী।
যদি চীনের সেনাবাহিনী তাইওয়ানে অভিযান চালাতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদেরকে জলপথ বা আকাশপথে গিয়ে পৌঁছাতে হবে সেখানে। কারণ, স্থলভাগ চীন থেকে তাইওয়ানে যাওয়ার কেনো উপায় নেই।
প্রতিবেদনে তাইওয়ানের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, চীনের সেনাবাহিনীতে বিপুলসংখ্যক সেনা সদস্য থাকলেও পরিবহন সক্ষমতায় ঘাটতি থাকার কারণে একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক সেনাসদস্যকে তাইওয়ানে পাঠাতে পারবে না চীন। এক্ষেত্রে দেশটিকে তাইওয়ানের নৌ ও বিমানবন্দরগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে এবং সেগুলো ব্যবহার করে কয়েক দফায় অভিযান চালানোর মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য, তাদের রসদপত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠাতে হবে।
আর এই ব্যাপারটিই চীনের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে— উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দেশের সবগুলো নৌ ও বিমানবন্দর সেনাবাহিনীর ব্যাপক সুরক্ষা ও নজরদারির মধ্যে আছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো দখল করা বাইরের কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যুদ্ধাভিযানের জন্য তাইওয়ানে আসা খুবই, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে চীনের জন্য।’
তাছাড়া, তাইওয়ানকে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করা তাইওয়ান প্রণালী এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিখার মতো কাজ করছে এবং কোনো ক্রমে যদি চীনের সেনাবাহিনী তাইওয়ানে পৌঁছেও যায়, সেক্ষেত্রে প্রণালী ব্যবহার করে সেনা সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো চীনের জন্য প্রায় অসম্ভব হবে বলে জানিয়েছে তাইওয়ানের সেনাবাহিনী।
এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তাইওয়ান প্রণালী—যা এই দেশের জন্য একটি প্রাকৃতিক পরিখা হিসেবে কাজ করছে—সেটি দিয়ে সেনা সদস্যদের জন্য রসদ পাঠানো অসম্ভব হবে চীনের জন্য। কারণ, প্রণালীতে যে কোনো বিদেশী শক্তিকে প্রতিহত করার শক্তি তাইওয়ান সেনাবাহিনীর আছে।’
‘তাইওয়ানের খুব কাছেই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সামরিক ঘাঁটি আছে। এছাড়া চীনের সীমান্ত ও দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের জলসীমা রক্ষায় চীনকে অবশ্যই তার সেনাবাহিনীর একটি অংশকে নিয়োজিত রাখতে হবে।’
‘ফলে পূর্ণ সামরিক শক্তি নিয়ে তাইওয়ান দখলে নামা চীনের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই কঠিন।’
দেশের সবগুলো নৌ ও বিমানবন্দর সেনাবাহিনীর ব্যাপক সুরক্ষা ও নজরদারির মধ্যে আছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে সেগুলো দখল করা বাইরের কোনো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই যুদ্ধাভিযানের জন্য তাইওয়ানে আসা খুবই, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে চীনের জন্য।’
চীন বরাবরই তাইওয়ানকে তার নিজস্ব ভূখণ্ড মনে করে, এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হলেও তাইওয়ানকে নিজেদের সীমানাভূক্ত করতে বদ্ধপরিকর দেশটির সরকার।
অন্যদিকে তাইওয়ান নিজেকে দাবি করে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে এবং নিজেদের স্বাধীনতা-গণতন্ত্র রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন এই ভূখণ্ডের জনগণ বরাবরই চীনের বিরুদ্ধে দখলদারিত্ব ও অশান্তি সৃষ্টির অভিযোগ করে আসছে।
চলতি বছর ফের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে বেইজিং ও তাইপের মধ্যে। তাইওয়ানের সরকারের অভিযোগ—সম্প্রতি তাইওয়ানের আকাশসীমায় কয়েকবার চীনের বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান অনুপ্রবেশ করেছে।
চীন-তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত থাকার মধ্যেই গত ৯ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, মূলভূমির সাথে তাইওয়ানের পুনরেকত্রীকরণ অবশ্যই সম্পূর্ণ করতে হবে। এই পুনরেকত্রীকরণ শান্তিপূর্ণভাবেই অর্জিত হওয়া উচিত, কিন্তু একই সাথে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে চীনের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি।
গত কয়েক বছরে কয়েক শতবার চীন তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে বেড়েছে চীনের সামরিক তৎপরতা। চীনের এই তৎপরতা মেকি হতে পারে, হতে পারে তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের জন্য সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। তবে, তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে চীনের তৎপরতা বৈশ্বিক মনোযোগের কারণ হয়েছে।
চীন আর তাইওয়ানের এই উত্তেজনার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে তাইওয়ানের ব্যাপারে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি। চীন তাইওয়ানকে দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ হিসেবে। আর বিশ্বাস করে, তাইওয়ান একসময় চীনের সাথে পুনরায় একত্রিত হবে, চীনের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
চীনের এই রাষ্ট্রীয় মতবাদের সাথে তাইওয়ানের অধিকাংশ মানুষই একমত পোষণ করেন না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হোক বা না হোক, একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবেই থাকতে চায় তাইওয়ানের অধিকাংশ মানুষ।
ইন্দো-প্যাসিফিক বলয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সম্প্রতি কোয়াড (QUAD) এবং অকাস (AUKUS) সামরিক জোট গঠন কিংবা চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতীয়তাবাদী চায়নিজ তাইপে (তাইওয়ান) নামে পরিচিত চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপটির মধ্যে স্পষ্টতই আবার নতুন করে একটি স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে উঠেছে। এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন এটি তাদের দীর্ঘদিনের ঘোষিত ‘এক চীন’ নীতির বরখেলাপ মনে করে। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাচীন ফরমোজা দ্বীপ বা তাইওয়ানকে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় মূল ভূখণ্ড অর্থাৎ বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সঙ্গে একত্রীকরণের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছিল বিগত সত্তরের দশকের আগে থেকেই। এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে মূল ভূখণ্ড অর্থাৎ চীনের দুই অংশের মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
শুধু তা-ই নয়, গণচীন তখন থেকেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে। এবং তখন থেকেই আন্তর্জাতিকভাবেও ধরে নেওয়া হয়েছে যে জাতীয়তাবাদী কিংবা বিচ্ছিন্ন চায়নিজ তাইপে (তাইওয়ান) চীনের মূল ভূখণ্ডের অংশ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী প্রতিনিধিরা এ বিষয়টি নীতিগতভাবে মেনেও নিয়েছিলেন। কিন্তু তাইওয়ান (চায়নিজ তাইপে) সেটি মেনে নিতে পারেনি এবং ভেতরে ভেতরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা করেছে।
নব্বইয়ের দশক থেকে তাদের সে স্বাধীনতা অর্জনের নীরব কার্যক্রম সরব হয়ে উঠতে দেখা যায়। শুধু তা-ই নয়, তাইওয়ান ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে যথেষ্ট সামরিক অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করেছে। তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার নয়া সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে তাইওয়ানের সঙ্গে গোপনে অস্ত্রের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমে ক্রমে তাইওয়ানকে আর্থ-রাজনৈতিক দিক থেকে পরোক্ষভাবে কিছুটা সমর্থনও দিতে শুরু করে। দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সাগরে চীনের সামরিক প্রভাব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে ওঠা যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা বর্তমানে এ ক্ষেত্রে তাইওয়ানকেও কাজে লাগানোর প্রয়াস পাচ্ছে। এ বিষয়টি চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরানসহ বেশ কিছু দেশকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচলিত করে তুলেছে।
গণচীন চেয়েছিল বিচ্ছিন্ন চায়নিজ তাইপের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় একত্রীকরণের পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করতে। কিন্তু তাইওয়ানের কিছু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় একত্রীকরণ কর্মসূচিকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার পথে সম্প্রতি অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, তাইওয়ানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাই লিং ওয়েন তাদের জাতীয় দিবসে গণচীনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করেন। তাতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টসহ কায়েমি স্বার্থবাদী নেতাদের কার্যক্রমে অত্যন্ত শক্তিশালী বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ দেখতে পান। তাতে চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে গণচীন যেকোনো সময়ে তাইওয়ান আক্রমণ করতে পারে।
তাইওয়ানের নেতারা ধারাবাহিকভাবে প্রচার শুরু করেন যে চীন সম্প্রতি বারবার অর্থাৎ একাধিকবার তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে। তাইওয়ানের এ ধরনের অভিযোগের পেছনে কোনো সারবত্তা নেই এমন নয়। তবে ১৯৪৯ সালের পর থেকে চীন অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে অর্থাৎ ধৈর্যসহকারে তাইওয়ানের সঙ্গে একত্রীকরণের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৬
আপনার মতামত জানানঃ